পৃষ্ঠাসমূহ

দেহাত্ববোধক কবিতা


আদমশুমারী

শহরের মত
গাঁয়ের মেয়েরাও যায় পার্লারে
মেক-আপ করে ও করায়
তারপর সম্ভ্রান্ত পথে হেঁটে
ঘেমে ও ঘামিয়ে প্রথাগত হয়ে যায়।

আমরা তারও হিসাব রাখি!

হেডম্যান

বিরাট অসঙ্গতির পর_
তুমি যাকে হেডম্যান নামে ডাকতে
দেখলে_ প্রকৃতিজুড়ে সন্ধ্যা হলে
তারও মাথা নত হয়_
প্রথাগত ঝিলের কাছাকাছি।

হাতঘড়ি

হাতকে ধরে থাকা ঘড়ি
নারীকে ধরে থাকা শাড়ী
_দুটো এক নয়।
তবুও দেখো_
প্রয়োজনে দুটোকেই খুলতে হয়।

সেলাইমেশিন

সেলাইমেশিন সর্বদাই রহঃ সহঃ নীতিতে বিশ্বাসী।

গতবারের সেলাই শেষে
দর্জি তার মজুরি পেল এ বছর।

ক্যালকুলেটর

মুদিঅলা আঙুলের কাজ ভাল পারে
মাস শেষে হিসাবের খাতা যায় গৃহিনীর ঘরে।

হ্যান্ডিক্রাফ্ট

অনেকণ তাকিয়ে ছিলাম জলের দিকে
জল; না-না তার আধারের দিকে
ভিজব ভিজব করছি অথবা ভাবছি_
তখন আধার বাধা দিল।
সেই থেকে বাঁধা পড়েছি নিজ বাহুডোরে
ভিজি এবং ভিজাই কিন্তু জলে নামি না।

প্রজনন

অন্ধকার বাণিজ্য করছে
আদিমতা কিনে নিয়ে
বিক্রি দিচ্ছে শৈলপাঠ।
আমরা অত্যন্ত যত্নে
নিজেদের নাম খোদাই করছি।

সব প্রস্তুতি ও আয়োজন শেষে
যখন কাজ সেই সময়ের মত শেষ হয়

প্রাণিবিদ্যার প্রজনন চ্যাপ্টার মোতাবেক
(সামাজিক দলিল ও লোকচুর সাীর ঝামেলা পেরিয়ে)
পাঠ নিতে শিখি গৃহস্থালী জীবনের।
সেখানে, লবণাক্ততার পর্ব শেষে
অপোকে দশ মাসের স্থায়িত্বে পৌঁছানোর কান্ত মুর্হুতে_
মুখ থাকে চিবুকের পাশে।
আর প্রজনণের হাতিয়ারটা আপাতত বিশ্রামে যায়।

দৌড়

আটতলা বিল্ডিং থেকে একবার
প্যান্থারের প্যাকেট নিচে পড়েছিল,
দেখে ভেবেছিলাম;
প্যান্থারেরা এত উপড়ে উঠে যায়!
আজ ষোলতালা থেকে নামতে নামতে ভাবছি
প্যান্থারেরা কত নিচে থাকে!

সংপ্তি কার্য বিবরণী

শাস্ত্র মতে, বিড়াল মারার রাতে
দ্বি-পয়ি চুক্তিতেই দীর্ঘ হয় রাত।
কম্পিত করতলে আগামীর স্বপ্ন রেখে
স্বপ্নমাখা হাত তখন সরিয়ে নেয়_
এক একটি পৃথক বিভাগের
বিভিন্ন বয়সে প্রাপ্ত_ বাঁধাসমূহকে।

তারপর খাটের একটা পরীা চলে
ঝড়-তোফানে টিকবে কেমন!

স্বপ্নে, মৎস্যকন্যা

স্বপ্নে কেবল নৌকাবাইচ
মাঝ রাতের নবজাতক ঘুম
দৃশ্য সপে দেয় মাঝির হাতে
মাঝি দেখে_
নদী জুড়ে জলীয় শ্যাওলা
তার ফাঁকে কয়েকটি মাছ।
মাছেদের প্রসঙ্গ এলে_বিবিধ প্রসঙ্গ আসে।

লোকাচার

পাতালপথ পাতালেই থাকা স্বাভাবিক
এই স্বাভাবিকতার সাথে প্রশ্নচিহৃ যোগ করে
আমরা তারও লিঙ্গান্তর ঘটাই।

ঘটিয়ে, ঘরে_ ঘরের বাহিরে
বাস্তবস্বপ্নে কত কী ভাবি!

ছায়ানৃত্য

পুরুষ মানুষ আজকাল ভেজা বেড়ালের মত
মাছটি উল্টিয়ে খাওয়ার সূত্র
উল্টিয়ে দিয়েছে। আমি এই কথা
তোমার ডানের রমণীয় কানে বলতেই তুমি
ডান হাতটা আমার এক ঝটকায় সরিয়ে দিলে_
কোমরের ফিতা থেকে।
রিঙ্াওয়ালা কিছু না বুঝে গান ধরে_
_ লোকে বলে আমার ঘরে নাকি...
আমি কি আর বসে থাকতে পারি?
হাতগুলোর সাথে সাথে ঠোঁটগুলোও এবার_
ব্যস্ত হয়ে রিঙ্ায় বসেই দেখল
পাশের রাস্তায় পাশাপাশি যাচ্ছে কি অদ্ভূত ছায়ানৃত্য

সিলেবাস

লাল কালি দিয়ে লেখা প্রথম অধ্যায়ের জন্যই
শিক-শিকিা বিরতি দিলেন প্রায়
তিনোধিক দিন।
শষ্যের মৌসুম এক সময় আসবেই...

শিক-শিকিা, ছাত্র এবং ছাত্রীকে
ব্যবহারিক ও তাত্তি্বক মিলিয়ে
সৃষ্টিতত্ত্বের সাধারণ নিয়মে
পাঠ শিখালেন অ, আ থেকে ঐ আহ্ পর্যন্ত।

পাঠ শেষে অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে
আগামীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে দুজনই
পড়ে গেলেন ধাঁধায়!

স্বপ্ন বিষয়ক জটিলতা

এমনও হয়!
মাঝরাতে নিদ্রাদেবীর কোল থেকে নেমে
তাকেই কোলের উপর বসাতে হয়।
বেশী কিছু না হলেও অর্প কিছু হয়!
তারপর দিনের শুরুতে শাওয়ারের নীচে
ভালো সময় দাঁড়াতে হয়!

জলীয় আলপনা

দেহের পসারী নিয়ে মাদুরে বসে
সরু চোখে দেখা পাশের জ্বলন্ত মানবী।

পদযুগলের দূরত্বহীন স্থানে
কত হয়েছে আনাগোনা।
রক্তের দসু্যতার কাছে হার মেনে; উতলা নদীতে
দ্রুতলয়ে টেনেছ বৈঠা।
শেষে, লবণাক্ত শরীর নিয়ে
ঢলে পড়েছ রহস্যঘেরা তীরে।

মাংসল ভূমিতে আঁকলে বুঝি জলীয় আলপনা!


সাময়িক বিরতি

চাষিতে আমি চাই যে ভূমি
চাষ বড় প্রয়োজন!
অনাবাদি! না থাকতে দেয়া যায় না
ভূমিই যে করে এমন আকর্ষণ!

চাষাবাদের ষোলকলা জানি আমি
আমি? আমি এখন অভিজ্ঞ চাষী।
লাঙ্গল জোয়াল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তেই
ভূমি বলে_ এখন মৌসুমের ক্রান্তিকাল
রহঃ রহ কিছুটা সময়, আগামী পরশু কাল!

সন্ধি

ভাদ্রমাসের লালনায় উত্তপ্ত শীতকাল
কানামাচির নিম্নাঙ্গের পট্টি উড়িয়ে
শরতের কাশবন উদ্ভোধন।

আহাঃ পাহাড়ি পথে এগোতে গিয়ে
শীতকালেও শ্বেদজল গড়িয়ে পড়ে- অহেতুক
ষড়ঋৃতুর দেশে নবীন পর্যটকের আর্বিভাব নিশ্চিত করে_
ঋৃতু বৈচিত্র ভুলে যাওয়া।

৩৬-২৪-৩৬

সাবালক হাতের দসু্যতায়
দুলতে থাকে জোড়া টুপির নিয়ন্ত্রিত জিনিসগুলো।
চলমানতার সূত্র মুখস্থ করে
পিটুইটারী গ্রন্থির ঈশারায়
হাত ছুটতে থাকে এক অচেনা শহরে।
শহরের গলির নাম্বার বড় অদ্ভুত!
ছত্রিশ থেকে শুরু হয়ে বার কমে
আবার পূর্বের নাম্বারে যায়।

৭-সতেরো : একটি ভিন্ন-ভাবনার কাগজ

৭-সতেরো : একটি ভিন্ন-ভাবনার কাগজ



"ভিন্ন ভাবনার প্রকাশ কিংবা ভাবনার ভিন্ন প্রকাশ"। এটাই এর মূল আলোচ্য বিষয়। কাজ করতে
চায় শিল্প-সাহিত্যের বৈচিত্র নিয়ে। বৈচিত্রময় সাহিত্যের প্রতিটি আঙিনায় অংশ নেবে কৌতুহলের দৃষ্টি নিয়ে।
এবারের কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে, 'হবিগঞ্জের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গন'। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, প্রবন্ধ, নাটক, শিশু-সাহিত্য, চলচিত্র, চারুশিল্প, সাহিত্য কাগজ সম্পাদনাসহ শিল্পের সকল শাখায় কাজ করছেন হবিগঞ্জের শিল্পের উত্তরসাধকগণ। এ সকল বিষয়ের আঁতুড়কথন জানতে এবং পাঠকদের জানাতে আগ্রহী। তাই এবারের বিষয়টি সাজানো হয়েছে_ "সৃজনশীলতার আঁতুড়কথন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ" শিরোনামে।
আশা করছি এর এই আয়োজনে আপনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে উদ্যোগটি বাস্তবায়নে অংশ নেবেন।

কী নিয়ে লিখবেন? সম্পাদনায়
তানসেন আমীন
সুমন আজাদ

# কাজের বিষয় হিসেবে উক্ত বিষয়টিকে নির্বাচন করার কারণ
# নিজস্ব কাজের ত্রে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন ও অভিজ্ঞতা

এছাড়াও এর আয়তনের ব্যাপারে সচেতন থেকে আপনি আপনার ইচ্ছে মতো যে কোন বিষয়ে লিখতে পারেন। প্রাসঙ্গিক আলোচনার েেত্র আপনার মন্তব্য/বক্তব্য/দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমরা আগ্রহ নিয়ে ছাপব।

এর আমন্ত্রণে যে সকল লেখক নির্বাচিত বিষয় নিয়ে "সৃজনশীলতার আঁতুড়কথন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ" শিরোনামে লিখবেন বলে আশা করা যাচ্ছে, তাঁরা হলেন ঃ

গবেষণাঃ ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ : তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল
প্রবন্ধঃ মাটি ও মানুষের মানচিত্র : এম এ রব
শিশু-সাহিত্যঃ বাঘ মামার মেয়ের বিয়ে : জাহান আরা খাতুন
উপন্যাসঃ স্বপ্ন দ্রোহ ভালোবাসা : পারভেজ চৌধুরী
সম্পাদনাঃ জন-প্রবাদ : আবু সালেহ আহমদ
নাটকঃ বিভাজন : রুমা মোদক
কবিতাঃ জোছনা ধরে রাতের হাত : অপু চৌধুরী
চলচিত্রঃ গণমানুষের মরমিয়া কবি : শাহ্ আবদুল করিম ও সিদ্দিকী হারুন
গল্পঃ পূর্ণিমা অথবা ফণিমনসা : সাইফুর রহমান কায়েস
চারুশিল্পঃ নির্বাচিত চিত্রকর্ম : রণবীর পাল


* মনোনীত কাজ (লেখা/বই/পাণ্ডুলিপি/পত্রিকা/ভিডিও/চিত্রকর্ম)- এর একটি কপি জমা দিতে হবে।
* লেখা অনুধর্্ব ৮০০ (আটশ) শব্দের মধ্যে হতে হবে।

বাজল সানাঁই || একটি বিয়ে স্মরণিকা






উড়ণচণ্ডি

উড়ণচণ্ডি/সুমন আজাদ

স্বপ্ন ডিঙিয়ে অবাক পতন পৃথিবীর বুকে...

আমি রাজপুত্র নই; অলস ভিখিরি
ভিার পাত্রে প্রতি রাতে এক নারী
রেখে যায় খোলে_
তার নিজস্ব সভ্যতা; তার ইতিউতি
আমি কি আর ও-সব বুঝি!
অবুঝ পুরুষ হয়ে রেখে দিই
পাঁজড়ের পাশে তার সব স্মৃতি।

ভাবনা-গদ্য অথবা কবিতার পক্ষে

আজকের কবিকে তাঁর নিজের উদ্দেশ্য ও কবিতার উদ্দেশ্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হয়। সে কবিতাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে কোথাও পৌঁছুতে চায় কি-না; এই প্রশ্নের মীমাংসা শুরুতেই করে নিতে হয়। অপর দিকে কেনো এবং কার জন্য লিখবে তা-ও নির্দিষ্ট করা জরুরি। কেননা, বাংলা কবিতা আজ এমন এক স্থানে পৌঁছেছে, যেখান থেকে সে কোনো অযাচিত কবি ও কবিতাকে তাঁর ছায়াতলে স্থান দিতে বাধ্য নয়। তবে, মিডিয়ার জন্য আজ এ ধরণের কবি ও কবিতা উভয়েরই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমি এই 'গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে' সমপ্রদায়টাকে শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা থেকে বিরত রেখে বাদবাকী কথাগুলো বলছি।
বাংলা কবিতায় বহু কবি তাঁদের যোগ্যতার স্বার রাখছেন এবং রেখে গেছেন। সেখানে যদি আর কোন প্রথাগত নতুন কবি, কবিতা না লেখেন; তবে মনে হয় না যে, বাংলা কবিতা অথবা বিশ্ব কবিতার খুব বেশী একটা তি হবে। আবার বছরের পর বছর ধরেও যদি কোন নবীন কবির স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর চিহ্নিত না হয়, তাহলেও নিশ্চয়ই খুব একটা আফসোস থাকবে না। কারণ, চর্যাপদের মাঠ পেরিয়ে বাংলা কবিতাকে দু'শ বছরের অনাবাদি জমিন পাড়ি দিতে হয়েছে।
তারপর মঙ্গল>মধুসূদন>রবীন্দ্র যুগ পেরিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের বিসতৃতি। সংেেপ তাই বলা যায়, বাংলা কবিতা তাঁর প্রধান কণ্ঠস্বরের জন্য অপো করতে জানে। শুধু মিডিয়ার দৌরাত্নে আমরাই অপো করতে ভুলে গেছি। প্রাপ্তির আকাঙ্খায় নিজের সৃজনশীলতায় কৃত্রিম 'তা' দিয়ে রাতারাতি ফুঁটিয়ে তুলছি আকাঙ্খার ডিম। অথচ বেমালুম ভুলে যাই_ সাহিত্যে প্রাপ্তি ও মূল্যায়ন সাধারণত একই সাথে হয় না। তবুও কেউ জনপ্রিয় বা বহুলপঠিত হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলে তাকে এই সত্য মাথায় রাখতে হবে যে, 'সত্যিকারের গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন উঁচুমানের মননশীল বই সাধারণত পাঠকপ্রিয় হয় না। সাধারণ পাঠকরা সেসব বইয়ের নাম জানেন, দূর থেকে শ্রদ্ধা করেন কিন্তু মননে কিংবা হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন না।'
(ভুমিকাঃ দৃষ্টিপাত/নাহিদ আহসান)
এটা অবশ্য সাধারণ পাঠকদের দোষ নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। সমাজের সব মানুষ যে সূ্ন অনুভূতি নিয়ে জন্মায় না; এই কথাটা রূঢ় হলেও সত্য। আর এই সত্যে বিশ্বাস রাখেন এমন পাঠক যেমন রয়েছেন, সাহিত্যিকও আছেন। সাহিত্য জগতে কোনো কোনো লেখক বিশেষ কোন শ্রেণীর পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করতেই পারেন। সেই লেখক যদি আজীবন এই একইভাবে বিশেষ শ্রেণীর পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করে সাধারণের কাছে দুবের্াধ্য রয়ে যান; সেজন্য ঐ লেখককে সাধারণের অপঠিত বলে মূল্যায়নে কারপন্ন করলে চলবে না। তবে, যাঁরা স্বভাবতই চিন্তাশীল, আত্নমগ্ন, কবি, তাঁরা চিরকালই নিঃসঙ্গ। তাঁরা অপ্রাপ্তির একটা ধারাবাহিক বঞ্চনা ভোগ করে যান জীবিতাবস্থায়। আর এইসব লেখককেই ধারণ করে লিটলম্যাগ। লিটলম্যাগের কণ্ঠ তাই চীরকাল-ই বিদ্রোহী।
খুব সম্ভবত, সচেতনভাবে এই বিদ্রোহী কণ্ঠের কোরাস বেঁজে উঠেছিল কল্লোলযুগে। কল্লোলে প্রকাশিত, 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, 'বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার কাজটি তিনি (রবীন্দ্রনাথ) অনেক বেশী কঠিন করে দিয়েছেন। একজনের বেশী রবীন্দ্রনাথ সম্ভব নয়; তার পরে কবিতা লিখতে হলে এমন কাজ বেছে নিতে হবে যে কাজ তিনি করেন নি; তুলনায় ুদ্র হলে_ হবারই সম্ভাবনা_ তাই নিয়েই তৃপ্ত থাকা চাই।" মধ্যযুগীয় অনাত্ন আবহকে অস্বীকার করে মধুসূদন দত্ত যেটুকু অগ্রসর হয়েছিলেন, তার তুলনায় তাঁর-ই আবহকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে মধুসূদনকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর অতিক্রমণের ধারায় কল্লোলযুগের উচ্চারণ ছিল, 'অন্ধভক্তির উপর আমাদের আর আস্থা নেই; আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞানকে। ভগবান, ভূত ও ভালবাসা_ এ তিনটি জিনিসের উপর আমাদের প্রাক্তন বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি।'
(বু:ব/অতি আধুনিক বাংলা সাহিত্য)
এই অস্বীকার প্রবনতার ফলে তিরিশের যে কবিতাবিপ্লব তার ধারাবাহিকতাকে গ্রহণ করে চলমান সময় পর্যন্ত এর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠিত চেতনাকে অতিক্রম না করে কোন ভাষাতেই নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটেনি। তবে, প্রতিষ্ঠিত চেতনাকে অতিক্রম করতে হলে কবিদের প্রথমত আত্নসত্তার প্রতিষ্ঠা তথা নিজস্ব স্বকীয়তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হয়।

আমার বিশ্বাস, কবিতা হচ্ছে সৃষ্টি ও নির্মাণ_ এই দু'য়ের সমন্বয়। কবিতা তৈরী হবে যুক্তি ও যাদুর সমন্বয়ে, এর শব্দ ব্যবহার প্রচলিত অর্থকে ধারণ করে কবিতাকে করে তুলবে ব্যঞ্জনাময়। কবিতার শব্দরা এক একটি অরচিত্র হয়ে

পাঠকের কাছে ক্রমাগত পৌঁছে দেবে সংকেতের পর সংকেত। সংকেত ও ইঙ্গিতের যৌথ বির্নিমাণে সৃষ্টি হবে কবিতা। এক এক সময় মনে হয় মিশেল ফুকো'র কথাটাই বুঝি সত্যি_ 'কবিতার পাঠান্তর ও জটিল বির্নিমাণের দ্বারা শিল্পের গোপন, লোকায়ত অবতল স্পর্শ করা যায়।'
এটা তো সর্বজনবিধিত যে, প্রত্যেক কবির কবিতায় ইনটুনেশন (নিজস্ব স্বরায়ন) প্রয়োজন। একে চিহ্নিত করা হয়তো সময়ের কাজ কিন্তু শুরুর প্রবণতা থাকা উচিৎ লেখকের মধ্যে। যদি পুরনো পথেই হেঁটে গেলাম, যদি অন্যের স্বরে কথা বললাম, অন্যের চোখে বিশ্ব দেখলাম_ তাহলে সেই বহুলচর্চিত অভিজ্ঞতা বয়ানের কি প্রয়োজন? তবে এ-ও হয়তো ঠিক নয় যে, স্বাতন্ত্রতা প্রকাশ পেলেই বড় মাপের কোন কিছু হয়ে যাওয়া যাবে!
কিন্তু এটাকে গন্তব্যে পৌঁছার সঠিক রাস্তায় হিসেবী পদপে হিসেবে নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা যায়।

মুঠোফোনের এই যুগে কবিরা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছেন অত্যাধুনিক আবিস্কারের সাথে। দ্রুতগতির যুগে সব কিছু বদলে যাচ্ছে দ্রুত। দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন। এখন মানুষ সব কিছুতেই ওই বিষয়টার নিযর্াস চায়। দিনদিন মানুষের ডিটেইলস এর প্রতি অমনোযোগিতা কিংবা অনাগ্রহ_ সাহিত্যেও প্রভাব ফেলছে। এর ফলশ্রুতিতে সাহিত্য বাজারে অণু'র আর্বিভাব। তবে এই পরিবর্তনের ফলে বাংলা কবিতা থেকে (কিছু অঞ্চলব্যাতিত) ন্যাকামি-টাইপ কথার্বাতা প্রায় বিদায় নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ১৯৫৪ সালের সেনেট হলে অনুষ্ঠিত দু'দিনব্যাপি কবি সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই কবি সম্মেলনের পর বাংলা কবিতায় সৃষ্টি হয়েছিল একটি প্রবণতা; আর তা হলঃ কাব্যপাঠ কবিকর্মের একটি অঙ্গ। চলল কিছুদিন। তারপর ভাব-ভাষার সোজাসুজি প্রকাশ ভঙ্গিটি ক্রমে কবিদের কাছ থেকে সরে আশ্রয় নিলো মিডিয়াবাজদের হাতে। আর তখনই কবিতা ভুল অর্থে হয়ে উঠল সামাজিক। তবে আজকাল সাবজেক্টিভ কবিতার র্চচা তেমন একটা হয়-ই না বললেও চলে। চারপাশের বহুর্মুখি অভিজ্ঞতা ও বিষয়ের বৈচিত্র্যতার ফলে সমকালীন (পরীণপ্রিয়) কবিদের কবিতায় চর্চিত হচ্ছে নিত্য-নতুন কনসেপ্ট। এর ফলে আধুনিক মন ও মনন বিশ্বায়নের ইতিবাচক সারায় মিলে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে, কবিতা পাঠককে (লেখক-পাঠক) কবিতা পড়তে হলে বসতে হচ্ছে অনেকগুলো চোখ নিয়ে।

আর এই এক একটি চোখ বহুদৃশ্য ধারণে সম।

এই সম চোখগুলোকে পুঁজিতে রেখে যারা অনুভূতির রাজ্যে সংকেত ও ইঙ্গিত নিয়ে নাড়াচাড়া করে আমি লেখালেখির েেত্র ঐ দলে থাকতেই স্বাছন্দবোধ করি। আর বিশ্বাস করি, কবিতা পাঠকরা কবিতাকে অনুভব করার জন্য মুটামুটি একটা প্রস্তুতিপর্ব পেরিয়ে অন্বেষণপর্বে নামেন। এই বিশ্বাস অল্পবিস্তর প্রায়োগিক হলেও; অমূলক নিশ্চয়ই নয়। কঠিন শব্দ দিয়ে কবিতা-শরীর গড়ার চেয়ে প্রচলিত ও পরিচিত শব্দের বুননে যে কবিতা রহস্যের চাদরে ঢেকে থাকে সে রকম কবিতার প্রতিই আমার আগ্রহ বেশী। কবিতা পড়ে অনুভূতির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া; হারিয়ে খুঁজে পাওয়া অথর্াৎ আবিস্কার-প্রবণতা রয়েছে এমন কবিতার প্রতি-ই ঝোঁকটা বেশী। যে সকল কবিতা পড়ে আবিস্কার করার মত কিছুই থাকে না কিংবা যে কবিতা চর্চায় রহস্যময়তা নেই, সে মত কবিতা চর্চায় অথবা পঠনে আমার আগ্রহ কম। কবিতার বিচারে অনুভূতি-ই হবে প্রধান নিয়ামক। আর এর প্রতিধ্বনিটা যেন নিজের কবিতায় শুনতে পাই সে দিকে ল্য রাখার চেষ্টা করি।

প্রকৃতির উপর মানুষের জয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা যে আত্ননির্ভশীল সমাজ-প্রক্রিয়া অতিক্রম করছি; সচেতনভাবে ল্য রাখতে হবে সেখানে যেন আবার কোন অদৃশ্য শক্তি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে না পারে।

স্বর-সন্ধানী কবি জফির সেতু'র ঃ "সহস্র ভোল্টের বাঘ"

[সহস্র ভোল্টের বাঘ। জফির সেতু।
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০৬।
প্রকাশকঃ শুদ্ধস্বর, ঢাকা।
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা।
মূল্যঃ পঞ্চাশ টাকা।]

সহস্র ভোল্টের বাঘ!
সাধারণত বাঘ বলতেই আমরা তেজদীপ্ত, সাহসী ও শক্তিশালী কোন কিছু ভেবে থাকি। আর সেই বাঘ যদি হয় সহস্র ভোল্টের_ তবে তো নিজেকে আরো সচেতন ভাবে প্রস্তুত করতে হয় সেই 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন শুনার জন্য।
বইয়ের ফাপ ও বিভিন্ন লিটলম্যাগ দেখে জানা যায় 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর কবি, জফির সেতু ছোট কাগজ চর্চার সাথেও জড়িত। তাছাড়া ফাপের প্রথম অংশে লিখিত বেনামী প্রাককথণে যখন দেখি...' _ যা অবশ্যই রাহমানের চিড়িয়াখানা-র চাইতে পৃথক, মাহমুদের আসঙ্গলিপ্সার থেকে দূরবর্তী, _গর্জমান এবং আলো-বিচ্ছুরণশীল যে চোখ ঝলসে দিতে সম...' তখন চোখের হিসেব ছেড়ে দিয়ে কানকে বলি_ তুমি প্রস্তুত হও গর্জন শুনার জন্য, মস্তিস্ক প্রস্তুত হও ধারণের জন্য আর হৃদয় তৈরী থেকো অনুভবের জন্য। তবে এবার কবি জফির সেতু 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন কতটা সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন সাদা কাগজের প্রতিটি পৃষ্ঠায়; তা আবিস্কারের জন্য পাঠ শুরু করা যাক।
যেহেতু এই কবির স্বর রাহমান কিংবা মাহমুদের মত নয়, (হবে-ই-বা কেন?) তাই একজন কবি'র কবিতা চলমান দশকেই পঠিত হচ্ছে বলে পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবী করতেই পারে।

"সিন্ধুর গোপন গান জীবনে খুব কম লোকে শোনে
আমাকে প্রতিভু পাখি ভেবে যারা বসিয়ে রাখে পাতায়
তাদের নাড়িতে টাইগ্রিস লোহিত উত্তেজনায় কাঁপে"
'এমন বসন্তদিনে'


তাই সঙ্গত কারণেই ছাবি্বশটি গর্জনে কেমন করে ফঁটে উঠেছে 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর চরিত্র_ তা দেখার দাবী রাখে।

"টাওয়ার থেকে যে ফড়িংটি নেমে এল
তার জন্য দরকার আরেকটি ইকোপার্ক
পৃথিবীর পথে পথে ইলেকট্রিক সিগন্যাল
এই ভেবে আমরা যখন পা থেকে কাদা ঝাড়ছি
নারীরা কী ভেবে যে ঘুম ঘুম চোখে কাঁদছে, শুধু কাঁদছে"
'ফড়িং'

আমার কাছে মাঝে-মধ্যে মনে হয়, একটি লাইন-ই বুঝি কবিতার প্রাণ কিংবা সমগ্র কবিতাই বুঝি একটা লাইন। যেখানে অনুভূতির গভীরে সহস্র লাইনের বিচ্ছুরণ ঘটে। আর এমন একটি প্রসঙ্গের আলোচনায় আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছিলেন, 'আসলে সবাই মিলে আমরা একটা কবিতা-ই তো লিখে চলেছি। এ যেন সহস্র নদীর একটি ঢেউ-এর মত।' তাঁর-ই এক লাইনের একটা কবিতা আছে এমন_ 'নষ্ট চোখে পাখিকেও পৃথিবীর ময়লা মনে হয়।' তেমনি জফির সেতু'র কবিতায়ও কিছু প্রাণসঞ্চারী পংক্তি আছে। পাঠকের জন্য উল্লেখ্য করছি_
ক. 'এখন তাদের এঁদো দালানে দুপুর রাতে পথ হারায় অন্ধ জোনাকি' [প্রত্যহ প্রবাহ]
খ. 'রাষ্ট্র বিপ্লবে কামার্ত রমণীরা কখনো বীরপ্রসূ হতে পারে না' [জীবন বৃত্তন্ত]
গ. 'মধুর চাকের অন্ধকার আমাকে জাগিয়ে রাখে' [আত্নজৈবনিক]
ঘ. 'কত লোভ আর ঝড়ো অন্ধকার মৃত্তিকার পাহাড়ে' [স্তন]
ঙ. 'পাতার আড়ালে পড়ে আছি অহেতুক পতঙ্গের মতো বহুকাল' [অহেতুক পতঙ্গ]

তবে কবিতার বিচারে কোন মন্তব্যই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের প্রেেিত এর আবেদন বদলাতে পারে এবং বদলায়। 'আমরা জানি সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার সংজ্ঞার্থের যেমন চরিত্র বদল ঘটেছে, তেমনি এককালের আধুনিকেরা সময়ের নির্মম বিচারে প্রথাগত অবিধায় বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু একটা জাতিস্বত্তার মিথ, প্রত্নস্মৃতি, নৃবৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম, ঐতিহ্যবোধ, প্রেম-অপ্রেম, মন ও মনন যখন কোন কবির আধার ও আাধেয়কে সম্পন্নতা দান করে_ তখন প্রথাচিহ্নিত বর্জনের তালিকায় তাকে নিপে করা যায় না।' [ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের তিন দশকের কবিতা: রফিক উল্লাহ খান]
কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কবিকে চিহ্নিত করতে হয় তাঁর স্বাতন্ত্র বা রহঃড়হধঃরড়হ দিয়ে। পূর্ববতর্ী থেকে নিজেকে আলাদা হিসেবে ঘোষণা দিলে তার জন্য প্রয়োজন পড়ে কিছূ আলাদা বৈশিষ্ট্যের।

শিশুর কড়ে আঙুলে গাঢ় টৌকা মারি ফড়িঙের ডানায় একটা হেলিকপ্টার বাঁধি' (ছায়া)

উক্ত কবিতাটিতে যে 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন মুদ্রিত হয়েছে তা আবিস্কারের পর কবি'র অভিলাষের প্রসংশা না করে পারা যায় না। এই পংক্তিতেই সহস্র ভোল্পের বাঘ এর সত্যিকারের গর্জন প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়।
কিন্তু 'প্রেম' কবিতায় যখন একই কবি আবার লিখেন_

'প্রেম, মাঝরাতে সঙ্গমরত টিকটিকি ধপাস করে বুকের উপর পড়ে যায়
দুপুরে অফিস ফাঁকি দিয়ে ছুটা বুয়ার সাথে ধস্তাধস্তি করে
প্রেম, তাগড়া ষাড়ের মতো মাটিতে হুংকার দিয়ে তেড়ে তেড়ে আসে
আমি কখনো এদের সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারি না!

তখন ভাবি, নীতি-নৈতিকতার ভয়ে যে কবি 'প্রেম' এর মত 'ট্রাডিশনাল ইমোশন' এর মুখোমুখি হতে ভয় পান তিনি নিজের

উম্মে মুসলিমার 'হ-য-ব-র-ল'

পত্রিকার বিভিন্ন সাময়িকীর সুবাদে উম্মে মুসলিমার লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কালের খেয়ায় প্রকাশিত লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছি বিগত দিনে। প্রতিটি লেখা ('ডার্করুম সহকারী' 'অসম' 'সৌদি চুড়ি') পড়ার শেষে বারবারই মনে হয়েছে তার প্রেেিত কিছু লেখি। কিন্তু সেই কাজটি হয়ে উঠেনি মূলত অলসতার কারণে। যাইহুক, এবার ৬৪-তম সংখ্যায় তাঁর লেখা গল্প 'জেবুনি্নসা' পড়ে মনে হল সত্যিই কিছু লেখা দরকার।

জেবুনি্নসা গল্পের শুরু এভাবে, 'আরতি রানী দত্ত ম্যাট্রিক পরীার পরপর বাড়ি থেকে উধাও।' অথর্াৎ গল্পের শুরুতে পাঠকদের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, আরতি যখন পরীা দেয় তখন দেশে ম্যাট্রিক (ম্যাট্রিকুলেশন; এস,এস,সি নয়) ধারণা প্রচলিত। তার মানে ঘটনার সময়কাল নির্দেশ। তবে আরো একটি জায়গায় সময়কালের ধারণা পাওয়া যায়। গল্পের চরিত্র সাবু (সাবুদ্দিন) সমর্্পকে লেখক বলেন, 'রামচন্দ্রপুরে ওরকম নায়করাজ রাজ্জাক কাটিং (রাজ্জাক কাটিং?) চেহারা আর ক'জনের আছে?' সুতরাং এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি গল্পের সময়কাল সত্তর থেকে আশি দশকের মাঝামাঝি। তখন অনেক তরুণই নায়ক রাজ্জাক দ্বারা প্রভাবিত হতেন। সেই সময়ের একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আরতি এবং আপাদমস্তক মুসলিম পরিবারের ছেলে সাবুর সংপ্তি প্রেমকে কেন্দ্র করে গল্পের ব্যাপ্তি। আর সেই আরতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, 'মুখখানা যেন ঠিক সরস্বতি ঠাকুরের মতো।(ঠিক বুঝলাম না 'সরস্বতি ঠাকুর' কথাটার মানে কি?) সেই আরতি প্রতিদিন সাবুর দোকানের সামনে দিয়ে স্কুলে যায়। গল্পকার দুজনের মধ্যে প্রেম বুঝাতে শুধু ইঙ্গিত করেছেন, 'সাবুর দিকে আরতি একবার তাকাবে, সাবু তাতে নিশ্চিত ছিল।' এছাড়া যেহেতু প্রেম কি করে হল তার আর কোন ইঙ্গিত নেই, তাই ধরে নিতে পারি লেখক আমাদেরকেও বলছেন যে, এদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে আপনারা নিশ্চিত থাকুন। গল্প থেকে আরো জানা যায় সেই সময়ের একটি মফস্বল এলাকার গঞ্জে আরতির জ্যাঠাতো ভাইয়ের দোকানে এবং সাবুর দোকানে টেলিফোন রয়েছে! সেই টেলিফোনের সাহায্যে জ্যাঠাতো ভাই দোকান থেকে খেতে গেলে আরতি সাবুর সাথে ফোনে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। অথর্াৎ সেই সত্তর-আশি দশকে ফোনালাপে প্রেম! তবুও লেখককে ধন্যবাদ তিনি চরিত্রগুলোর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেন নি! সেই ফোনালাপে আরতি এতই মগ্ন হয় যে ইসলামী নিয়ম-কানুন শিখার জন্য বাজার থেকে নিজেই 'সহজ নামাজ শিা' কিনে আনে! প্রেমাসক্ত আরতি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে ইসলামের জন্য! অবশ্য লেখক এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, 'আরতিরও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কোনো আপত্তি নেই।' সাবুরা এলাকায় প্রভাবশালী। অবস্থাসম্পন্ন মিয়া বাড়ির দরাজ মিয়ার তৃতীয় কনিষ্ঠ পুত্র সে। তার পিতা আবার মসজিদের ইমাম। আর সেই ইমামের ছেলে সাবু ভাগিয়ে নিয়ে আসে আরতিকে নিজের বাড়ি। এদিকে আবার হারিয়ে যাওয়া আরতিকে দুদিনেও খুঁজে পায় না তার পরিবার। পরে আরতির মা মেয়ের বালিশের নিচে থেকে নামাজ শিা এনে তার ভাশুরের ছেলেদের দেখান। (আরতির বাবার কোন উল্লেখ নাই) তা দেখে জ্যাঠাতো দাদা লণ যৌতুকে পাওয়া হান্ড্রেড টেন (হান্ড্রেড টেন! রাজ্জাকের সময়কালে!) মোটরবাইক চালিয়ে সাবুর বাড়ি খুঁজতে আসে। আমরা ল করি যে, গল্পে আরতির দাদা হান্ড্রেড টেন মোটর সাইকেল চালায়, দোকানে টেলিফোনও আছে। অপর দিকে সাবুর বাবা চলাচল করেন ছইওয়ালা মহিষের গাড়ি দিয়ে। এসবের প্রেেিত আসলে কে যে অবস্থাসম্পন্ন; প্রশ্ন জাগে? তারপরও লেখক যেহেতু বলেছেন সাবুর বাবা অবস্থাসম্পন্ন অতএব, সাবুর বাবাই অবস্থাসম্পন্ন। সেই অবস্থাসম্পন্ন কড়া ইমাম (গল্পে উল্লেখ আছে, 'দরাজ মিয়ার কড়া নির্দেশ, তার জীবদ্দশায় কেউ আলাদা হতে পারবে না।) পিতার কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দু মেয়েকে বউ করার জন্য নিয়ে আসায় তিনি খুবই পুলকিত! তার পুলকের বর্ণনা পাওয়া যায় আরতিকে খুঁজতে আসা জ্যাঠাতো ভাইয়ের সাথে কথোপকথনে। তিনি তাকে সাবুর বন্ধু ভেবে বলেন, 'ও, সাবুর ইয়ার বুঝি আপনি? এত দেরি করলেন আসতে? আজতো আমার সাবুর বৌভাত। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি তসরিফ রাখুন। হাতে মুখে পানি দেন। আমি আগে খানার ব্যবস্থা করি।' পরে যখন তিনি আরতির জ্যাঠাতো ভাইকে চিনতে পারেন, তখন সাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'তোর বড় কুটুম বুঝি? আরে আপনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত মেহমান।...সাবু তুই আমার জেবুনি্নসা মাকে নিয়ে আয়' অথর্াৎ এই ফাঁকে বিয়ে হয়েছে। আরতির নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে জেবুনি্নসা। সেই জেবুনি্নসা কি সাবলীল ভাবে তার জ্যাঠাতো ভাইয়ের সামনে এসে বলে, 'মা-বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করবে। আমি খুব ভাল আছি।' এই তার পরিবারের সাথে শেষ আলাপ। পরবর্তি অংশে চলে জেবুনি্নসা ওরফে আরতির মুসলিম রীতি-নীতি আত্নঃস্থ করার পালা।



সাবুর বাবার উদারতা মুগ্ধ হওয়ার মত। তবে আমরা তো এই সমাজেরই মানুষ। তাই সমাজের মানুষগুলোর বৈশিষ্ঠের কথা কম বেশী সবার জানা আছে। আজ এই একবিংশ শতাব্দিতেও দরাজ মিয়ার মত উদারপন্থি ইমাম, যে কিনা মহা খুশিতে তার হিন্দু পুত্রবধূকে বরণ করে নেয়; চোখে পড়ে না। আর সময়টা যদি হয় সত্তর-আশির দশকের মফস্বল_ তবে তো কথাই নেই। গল্পের আরো কিছু ব্যাপার অবাক করে দেয়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে ঢাক বাজিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করে আসছে। কিন্তু তা বাজানো হয় কিছু নির্দিষ্ঠ সময়ে। যেমন, ষষ্ঠীতে সন্ধ্যার পর ঢাক বাজিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে পূজা মন্ডপগুলোতে বোধন সম্পন্ন করা হয়। এই রীতি হয়তো মুসলমান অধূ্যসিত এলাকায় রমজান মাস হলে সময়ের কিছুটা এদিক সেদিক করে পালন করা হয় কিন্তু কখনোই তা ভোরে চলে যায় না। গল্পকার যখন লেখেন, 'পরদিন ষষ্ঠী। ঠাকুর ভিটেয় উঠবে। ভোরবেলা ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বুকের মধ্যে বাদ্য বেজে উঠল...' তখন বাদ্য আমাদের বুকেও বেজে উঠে আর তা হচ্ছে বিস্ময়ের! আর বিস্ময় নিয়ে ভাবি, একি অন্য রীতির প্রতি লেখকের অবহেলা নাকি অজ্ঞতা? অজ্ঞতাই বা বলি কি করে!

গল্পটা পড়ে কি বুঝা গেল কিংবা কেন লেখা হল; তার কোনো উত্তর মিলে না। এই গল্পের উদ্দেশ্য কি প্রশ্ন করলে যদি উত্তর হয় জেবুনি্নসা ওরফে আরতির মাধ্যমে রমজান মাস উপল েপাঠকদের আবারো ইফতারের দোয়া (গল্পে আরতির মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ ইফতারের দোয়া পড়িয়েছেন গল্পকার) মনে করিয়ে দেয়া তবে বলল উদ্দেশ্য একেবারে সফল। ধান ভানতে শিবের গীতটা একটু বেশী গাওয়া হল; এই যা। আর যদি গল্পের শিল্পমূল্যের দাবী উঠে তবে কিন্তু পাঠক নিরুপায়।
প্রকাশক কিংবা সম্পাদকের অনুরোধে অনেক লেখকই লেখা তৈরী করেন। 'জেবুনি্নসা' গল্প পড়ে মনে হয়েছে যেন লেখককে কেউ বলেছেন_ সামনে রোজা এবং পূজা। এই পূজা আর রোজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারকে নিয়ে একটি প্রেম জাতীয় লেখা তৈরী করুন; যা পাবলিক খাবে। আর যেহেতু আপনি মুসলমান এবং মুসলিম প্রধান দেশ সুতরাং সে ধর্মই যেন প্রাধান্য পায়। এরকম ঘটনা যদি অন্য যেকোন সাময়িকীর েেত্র ঘটতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কালের খেয়াকে কেন্দ্র করে আরোপিত, ফরমায়েসি লেখক গড়ে উঠুক; এমনটা কখনোই কাম্য নয়।
আমরা যারা পাঠক তারা জানি, গল্পকারকে সমাজ, সময়, সংস্কার ও কাহিনী বর্ণনায় সজাগ থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় লেখাটা যেন শুধু শুধু কলমের টানে এগিয়ে না গিয়ে বিবেক-বোধ, যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই সাথে পাঠকের আস্থা ও চাহিদাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিশ্বস্থভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনও রয়েছে। আরোপিত কাহিনী পাঠকরা চীরকালই প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই সাথে সাথে লেখককেও। কিন্তু এমনটা যেন উম্মে মুসলিমার েেত্র না ঘটে। কারণ এই গল্পকারের লেখার মত পর্যাপ্ত মতা আছে। শুধু মতাটা একটু যাচাই করে একটা গল্প তাঁর কাছে যতটুকু সময় দাবী করে সেই অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত। আর একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে তাঁর কাছে এটুকু দাবী নিশ্চয়ই করতে পারি?

বিসর্জন পর্ব

বিসর্জন পর্বঃ এক

জীবন; সে তো ট্র্যাফিক সিগন্যাল
সবুজ সংকেত জ্বললেও
অপেক্ষায় থাকে-
লোমশঃ হাত নেমে যাবার।
তারচেয়ে বরং জলকাব্য লেখি
স্রোতঃ ফেলে আসা অতীত
তারল্যের উচ্ছ্বাসে তটস্থ পাড়।
কান্নালিপি বালুচরে নয়
বালুচর প্রতারক, খড়িমাটি ভুলোমনা
তারচেয়ে বরং লিখে রাখি নয়নপাত্রে।



বিসর্জন পর্বঃ দুই


গিরি-খাদে পরিত্যাক্ত লালসা সকল
অহেতুক স্বপ্ন হয়ে যায়
মাটি ও আকাশ প্রসঙ্গ ভুলে
মূক ও বদিরতার দেয়ালে
আল্পনা আঁকে_ যুগলবন্দি।
যুগলচিন্তা সাথী হারায় চতুর সময়ে
আজকের বাজারে সর্বোচ্চ ক্রেতা
স্বপ্ন কিনে নেয় সৌখিন দামে।


বিসর্জন পর্বঃ তিন


সমান্তরালের গান
আজো শিখা হল না আমার
শুধু বামুন আর চাঁদের গল্প মুখস্থ করেছি
ফলাফল অসমাপ্ত ভাগশেষ।
আর ঐ আমার সাথে সাথে
যে ভাগশেষের শেষে পড়ে রইল
সেও জানলো-
মাঝি অল্প বয়েসি হলে
আকাশের খবর তেমন একটা রাখে না
মনের খবর ছাড়া।


বিসর্জন পর্বঃ চার


ক্যালেন্ডার ঝুলে আছে
তারিখগুলো_ দিনগুলো_ মাসগুলো_
রেখাবন্দি থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
বুঝতে পারছি_
আমাকেও মুক্তি দিচ্ছে কেউ
হার্ডবিট, শ্বাস-প্রশ্বাস, অনুভূতি ও স্পর্শ থেকে।


বিসর্জন পর্বঃ পাঁচ


সাদৃশ্য বজায় রেখে সূত্রসন্ধি
বিবর্তিত হতে হতে_
হয়ে যাচ্ছি ভুলে যাওয়া তক্ষক।
সন্ত বলেছিল, বৃষ্টি আসলে
কোন এক মজবুত ঘরে আশ্রয় নিবি।
সেই ঘর খোঁজে আজো বৃষ্টিকে
ডাকতে পারছি না করিডোরে।
স্পর্শগুণ হারিয়ে ক্রমেই-
হয়ে যাচ্ছি আশ্চর্য গন্ধমানব।


বিসর্জন পর্বঃ ছয়


মেঠোপাখি উড়ে যাবে
ডানার আয়োজন দেখে
অংক মিলাতে বসে পরিত্যাক্ত সনদ।

সনদ; ডানারা এমনই হয়
রোদের গন্ধ মুছে, স্মৃতিঘর ডিঙ্গিয়ে
অবশেষে জীবন দা'র কবিতায় মিলায়।


বিসর্জন পর্বঃ সাত


কান্নাপর্বে মেঘগুলো বিস্ময় পাহাড়
থেমে থাকা জল
ছুটতে থাকে পাহাড়ী ঝর্নার মত।
অভিযুক্ত সিন্ধুমাঝি
সেই জলেরই ছুটে চলা দেখে।

প্রেমঃ আজো মধ্যবিত্তের হল না!



বিসর্জন পর্বঃ আট


রুগ্ন ক্যানভাসে সতেজ শিল্প
অসহায় আয়োজন।
পড়ে থাকা প্যাকেটবন্দি নিদ্রাসমগ্র
এক একটি সঙ্গী হয়েছে জলের।
তবুও অবুঝ প্রত্যাশাগুলো
ঘন্টা শুনে শেষ রাতের।
শেষ রাত; তুমিও আমার মত
প্রেমিক ছিলে বুঝি!


বিসর্জন পর্বঃ নয়


মধ্যরাত শব্দ তুলে কৌতুহলে জানতে চায়
স্বপ্নবুনণ কী থেমে আছে সুতো সংকটে?
তার প্রেক্ষিতে উত্তর আসে-
বুনণ যন্ত্র হারিয়ে গেছে সুতোসহ
বৈশ্বিক বাজারে।



বিসর্জন পর্বঃ দশ


খেলা থেমে গেছে
ঘরে ফিরে যাও পলাতক প্রেম
ঘাসের ডগায় শিশির বালিকা
বহু দেখেছো চশমা পড়া চোখ
এবার মধ্যস্থতার ব্যবধান জেনে
পড়তে শিখো বিরহের নামতা।

রাত জাগা হলুদ পাখির গানে
সূর্যসঙ্গমে অভ্যস্থ হও
তুমি বরং কবি হও

যেখানে বিয়ে হয় পরিবারে পরিবারে, ছেলে আর মেয়েতে নয়

"Where marriage is performed between two families and not between a boy and a girl"

...প্রক্রিয়াধীন

মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও আমাদের সরকার: কণ্ঠকময় পথচলা

"The practice of the freedom of thought and our Government: A pilgrimage"
...প্রক্রিয়াধীন

ইসলামে নারীর বন্দিত্ব; আত্নরক্ষার মাধ্যম পর্দা নাকি ব্যাক্তিত্ব?

“The Imprisonment of women in Islam: The medium of protecting the self is curtain or personality"

...প্রক্রিয়াধীন

তরুণ প্রজন্ম, ধর্ম এবং জঙ্গীবাদ, ধর্মের প্রতি উদাসীনতা কিংবা আমাদের ধর্মহীনতা

“Young Generation, Terrorism and careless – attitude towards Religion or our Religiousness"

...প্রক্রিয়াধীন

আমি কেনো চাই না আমার বান্ধবী বোরকা পড়ুক!

সলামী দেশ এবং এর রীতিনীতির মধ্যে যা আসে তার মধ্যে পর্দাপ্রথা বা হিজাব অন্যতম। আমাদের দেশ সাংবিধানিক ভাবে ধর্মীয় হলেও গণতান্ত্রিক শাষণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও কোরান ও সুন্নাহ’র শাসন ব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই নাগরিকরা কিছুটা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন এবং বিধর্মীরা একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন। কিন্তু কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক শাষণ ব্যবস্থা চালুর জন্য মরিয়া কিছু উগ্র ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং এর অংগ সংগঠনগুলো ইসলামী বিভিন্ন কট্টরপন্থি নিয়মনীতি চালু করে দিয়েছে। তার মধ্যে ‘হিজাব’ উল্লেখ্যযোগ্য।
স্বাভাবিকভাবে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নারী। কেনোনা তারা জানে একটি নারীকে বন্দী করতে পারলে পরিবারকে বন্দি করা সম্ভব। তাছাড়া, নারী জাতি সহনশীল এবং তুলনামুলকভাবে কম প্রতিবাদী হওয়ায় তাদেরকেই লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছে উগ্র ইসলামী গুষ্ঠিগুলো। আর এর প্রভাব পড়েছি বাংলাদেশের সর্বত্র। একটি দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠে যখন ছাত্রীদের বাদ্য করা হয় বোরকা পড়তে, তখন অবাক না হয়ে পারি না! কিন্তু একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এই আরোপিত ‘হিজাব’ কে সমর্থ করতে পারি না। আর আমি তাই চাইও না আমার কেউ বোরকা পড়ুক। তাহলে ব্যাখ্যা করেই বলি, “আমি কেনো চাই না আমার বান্ধবী বোরকা পড়ুক”।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জনের মত মুসলিম। স্বাভাবিক ভাবে জন্মগতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হচ্ছে ইসলাম। নারী পুরুষের সংমিশ্রণে এই দেশ। আর নারী ও ইসলাম নিয়ে কথা উঠলেই কথা আসে পর্দাপ্রথার অর্থাৎ হিজাবের। ইসলামে নারী ও পুরুষ সবাইকে পোষাকের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া আছে। কিন্তু কাজ ভেদে, খেলাধূলার ধরন ভেদে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে, ভৌগলিক অবস্থান ও অঞ্চল ভেদে, কখনো বা সময়ের প্রভাবে পোষাক যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাল্টায়। যাতে ঐ বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ তার ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু ইসলামে নারীর পোষাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ পোষাকের এই যৌক্তিক কার্যকারণগুলোকে মানে না। তাই এত বিতর্ক। অন্যান্য অনেক ধর্মেও নারীর পোষাক সম্পর্কে একরকম চাপিয়ে দেয়া আইন-কানুন আছে (মাদার তেরেসা বা তার অনুসারীদের পোষাক; মাথায় কাপড় ও লম্বা হাতার বস্নাউস দেখলে তাদেরকে মুসলিম পর্দানশীন মহিলাই মনে হয়)। সেসব ধর্মের নারীরা প্রতিবাদ করে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের জন্য স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মুসলিম নারীসমাজ সেই অবস্থা এখনও অর্জন করতে পারেননি।

আসুন দেখি হিজাব শব্দটি কোথা থেকে এসেছে। শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ হাজাবা থেকে, যার অর্থ লুকানো। কোরানে হিজাব ছাড়াও 'জিলবাব' ও 'খিবার' এর কথাও আছে। কিন্তু ধর্মানুসরণ করে মুসলিম রমণীরা বিভিন্ন দেশে আরো বিভিন্ন রকমের পোষাক পরেন যা ধর্মের চেয়েও মূলতঃ তাদের সাংস্কৃতিক বা অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যের বিষয়টিই তুলে ধরে। এ ধরনের পোষাক ও তার ছবি প্রায়শই বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় যে ছবিগুলো দেখলে নারীদের এক ধরনের কয়েদি বা অন্যগ্রহের কোনো আজব প্রাণি বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, জেলখানার কয়েদিদের যেমন পরিচিতির সুবিধার্থে এক ধরনের পোষাক পড়তে বাধ্য করা হয় এসব নারীরাও সামাজিক ও ধর্মীয় নীতি-নির্দেশের কারণে একধরনের বিশেষ পোষাক পরতে বাধ্য। শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ এবং যুগ যুগ ধরে আবদ্ধ থাকার ফলে এখন অভ্যস্থ। আর এই হিজাবের রয়েছে ধেশ অনুযায়ী বিভিন্ন নাম এবং ধরণ। বিভিন্ন মুসলিম জন-প্রধান দেশে যেসব পোষাক পাওয়া যায় তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হলো।

• মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় দেখা যায়: হায়েক, সাফসারি, আখনিফ এবং আজার।
• মিশর, ইজরায়েল, সিরিয়া, ইরাক ও বেদুইনদের মধ্যে দেখা যায়: আবায়া, তারনা, ইজার, মিলহাফা, খাবারা, চাম্বার, নিকাব, লিথাম, ও বোরকো।
• ইরানে দেখা যায়: বোরদা, চাদর, পিচা এবং রৌবন্ধ।
• তুরস্কে দেখা যায়: ইয়াচমেক, ইয়ালেক, হারমানিয়া, ও এনতারি।
• বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপে দেখা যায়: বোরকা।

মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে এই পর্দাপ্রথা হয়ে উঠেছে প্রধান অন্তরায়। দাসত্বের এই প্রতীকের জন্য তারা ক্ষমাগত নিম্নমুখি হচ্ছে। পুরুষ আধিপত্যের শেকল ছিঁড়ে নিজ গৃহের বন্দিত্ব থেকেই মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে নারীরা এর বিরোধীতা করে নি তা নয়। মুসলিম রমণীরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এসব প্রথার বিরুদ্ধে।
১৯২৩ সালে মিশরে প্রথম একটি প্রতিবাদ হয়, মিশরের ফেমিনিস্ট ইউনিয়নের প্রধান মিজ হুদার নেতৃত্বে। তিনি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে তাদের পর্দা ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। তুরস্কে হিজাবের বিরুদ্ধে সরকার থেকে লড়াই শুরু হয় ১৯২৭ সালে। তখন কম্যুনিস্ট সরকার ছিল ক্ষমতায়। সেই সময় ৭,০০০ মহিলা প্রকাশ্যে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের সাথে শত্রুতা করার জন্য তাদের ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজকের যে কট্টর আফগানিস্তান সেখানেও বাদশা শাহ এর সময় স্বাধীনতা উৎসবে, ১৯২৮ সালে পর্দাপ্রথার শেকল থেকে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে জনসম্মুখে পর্দা ছাড়া উপস্থিত হতে বলেছিলেন। পরে মুসলিম মৌলবাদীর ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে নারী মুক্তির সব ধরনের প্রকল্প তাকে বাদ দিতে হয়েছিল। ক্ষমতাও ছাড়তে হয় তাকে। ইরানের রেজা শাহ ১৯৩৬ সালে একটি বিশেষ আইন করে 'চাদর' পরা বন্ধের আদেশ দেন। কিন্তু সংস্কৃতির বিপক্ষে তার এই আদেশ জনপ্রিয়তা পায়নি এবং জনপ্রতিবাদের মুখে ১৯৪৬ সালে তিনি আবার তা পুনর্বহাল করেন।
আজকে যেমন বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন স্থানে ‘হিজাব’ নিয়ে বিতর্ক চলছে, তেমনি ইসলামে হিজাবের উৎপত্তির কারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
তবে কোরানে এ সংক্রান্ত আয়াত গুলোর (৩৩.৫৩, ৩৩.৫৯, ৩৩.৩২-৩৩) মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নীচের আয়াতটি (২৪:৩১)

“And say to the believing women that they should lower their gaze and guard their modesty; that they should not display their beauty and ornaments except what (must ordinarily) appear thereof; that they should draw their veils over their bosoms and not display their beauty except to their husbands, their fathers, their husband's fathers, their sons, their husbands' sons, their brothers or their brothers' sons, or their sisters' sons, or their women, or the slaves whom their right hands possess, or male servants free of physical needs, or small children who have no sense of the shame of sex; and that they should not strike their feet in order to draw attention to their hidden ornaments. And O ye Believers! Turn ye all together towards Allah, that ye may attain Bliss.”

হিজাব, পর্দা ইত্যাদির চল এবং মুসলিম রমণীরা বাড়িতে থাকবেন এ ধরনের প্রথা ইসলামের মাধ্যমেই মক্কা-মদিনায় চালু হয়। কিন্তু সমসাময়িক বেদুইন মহিলারা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তারা তাদের স্বামীর সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং নতুন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে জীবন ধারনের কাজে একত্রে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু অন্যান্য সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাবে ইসলামেও বিভিন্ন পর্দা-প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে। হিজাব বা পর্দাপ্রথাটির বিষয়টি আরবরা গ্রহণ করে পারসিদের কাছ থেকে। মহিলাদের ঘরে থাকার আদেশটি আসে বাইজাইন্টাইন ঐতিহ্যের অনুকরণে, যারা মূলতঃ এটি পেয়েছিল একটি প্রাচীন গ্রিক প্রথা থেকে।

পর্দা নারীর মুক্ত বিচরণকে রুদ্ধ করে দেয় এটি বলার অবকাশ রাখে না। যদিও মুসলিম রমণীদের অনেকে তাদের প্রয়োজনমত এসব নিয়মকানুনকে একটু মোচড়ে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব একটা সরব প্রতিবাদে তারা সহজে জড়াতে চান না সাধারণত পরিবার সমাজ ধর্ম এবং রাষ্ঠ্র আরোপিত শাস্তির বয়ে। কিন্তু ‘হিজাবের’ অর্থ কেবল পোষাকের মাঝে জড়িত মনে করলে ভুল করা হবে। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরো অনেক নিয়ম-নীতি। যদি প্রশ্ন উঠে যে মুসলিম নারীর কি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে? এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে তার নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাও হিজাবের বা পর্দা প্রথার অংশ।
এ বিষয়ে কোরানের সংশিস্নষ্ট আয়াত হচ্ছে ৩৩.৩৩:

“And stay quietly in your houses, and make not a dazzling display, like that of the former Times of Ignorance; and establish regular Prayer, and give regular Charity; and obey Allah and His Messenger. And Allah only wishes to remove all abomination from you, ye members of the Family, and to make you pure and spotless.”

এই যে ঘরের মধ্যে নীরবে থাকার নির্দেশ; তা কোরানের। যারা ইসলামের সংশোধনে বিশ্বাসী এবং নিজেকে বিতর্কের বাহিরে রাখতে চান তারা এর সাথে আগের আয়াত যুক্ত করে একে চিহ্নিত করেন শুধুমাত্র নবীর স্ত্রীদের জন্য আদেশ বলে। যদিও নবীর কাজ এবং সম্মতি হাদিসের আওতায় পড়ে। যারা গোঁড়া/উগ্র মৌলবাদী কিংবা ইসলামী শাসন কায়েমে বিশ্বাসী তাদের মতে এই আদেশ সকল মুসলিম রমণীদের জন্য। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হয় নানা কারণেই। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমাগত প্রচারনার মাঝে মুসলিম ধর্ম-বেত্তাদের পক্ষে নারীকে আর শুধু ঘরে আটকে রাখার বিধান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না (বিশেষত: শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে)। তবে, ইসলামী মতেও একজন নারী ঘরের বাহিরে যেতে পারেন। আসুন দেখি কিভাবে একজন নারী ঘর থেকে বের হতে পারে তার নমুনা:

(কোরান ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন মুসলিম মনীষিরা এই নীচের তালিকাটি ব্যবহার করেন)

• ১. শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মুসলিম নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশেষ প্রয়োজনটা কি? কোন অবস্থায় একজন নারী ঘর থেকে বের হতে পারবেন তা নির্দিষ্ঠ নয়। আমরা যদি মনে করি একজন নারীর প্রচন্ড মাথা ব্যথা এবং তার ঔষধ প্রয়োজন, তখন তিনি কি করবেন? অথবা রান্নার সময় ঘরে লবণ নেই, তাও কি বিশেষ প্রয়োজনের আওতায় পড়ে?

• ২. তার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার স্বামী বা আইনসঙ্গত অভিভাবকের অনুমতি থাকতে হবে।

নারীর ঘরের বাহিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপরের নিয়মের সাথে এই নিয়মটি সাংঘর্ষিক। কেননা, যদি বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যেতে পারে, তাহলে আইনসঙ্গত অভিবাবকের অনুমতির দরকার কি? আর যদি অনুমতি অবশ্যই দরকার হয় তাহলে বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যাবে কি করে? এখানে আরো প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন, একজন অবিবাহিত মেয়ে তার পিরিয়ড চলাকালে যদি স্যানিটারি নেপকিন কিনতে বাহিরে যায় এবং তার বাবার কাছে অনুমতি চায় আর তখন যদি তার বাবা কারণ জানতে চান (অবশ্যই কারণ বলতে হবে)তখন সে কি বলবে?

• ৩. তাকে মুখ সহ পুরো শরীর ভালোভাবে ঢাকতে হবে, যাতে আশে-পাশের কোনো পুরুষকে তার রূপ লালসাগ্রস্থ না করতে পারে এবং সে অবশ্যই তার মাথা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে সোজা হেটে যাবে। (কোরান: ২৪:৩১)

প্রথমত আমরা যদি চিন্তা করি একজন মানুষ সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে, তাহলে শুনতে কেমন লাগবে? আসলে এখানে এই ‘কেমন লাগবে’ ভাবার আগে ভাবতে হবে কোরানে উক্ত কথাগুলো অনুদিত হওয়ার আগে নারীকে ‘মানুষ’ ভাবা হয়েছে কি না? পুরুষকে তার রূপ লালসাগ্রস্থ করতে পারে বলতে নারীকে সরাসরি ভোগ্যপন্য হিসেবে স্বয়ং কোরানেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভোগ্যপন্যের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে তা তো অনুমান করাই যায়।

• ৪. পুরুষদের সাথে পথের মাঝ দিয়ে সে হাঁটতে পারবে না। মসজিদ থেকে কিভাবে বের হতে হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে ইসলামের নবী আদেশ দিয়েছেন: "নারীদের পুরুষের মাঝে হাঁটার কোনো অনুমতি নেই; তোমাদের উচিত রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটা।"

“নারীদের পুরুষের মাঝে হাঁটার কোনো অনুমতি নেই; তোমাদের উচিত রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটা।” যারা এখন মাঝে মাঝে দাবী তুলেন, ইসলাম নারীকে অনেক আগেই সম-অধিকার দেয়া হয়েছে এই একটি উদ্ধৃতি তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যতেষ্ঠ। পুরুষের পাশাপাশি নারীকে কতটা সম্মান আর অধিকার দেয়া হয়েছে তা এই হাদিস থেকেই বুঝা যায়। যেখানে পর্দা বা ‘হিজাব’ করার পরও নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা রাখা হচ্ছে।

• ৫. হাঁটার সময় পা মাটিতে ফেলে শরীরের গোপন অলংকারের শব্দ করা যাবে না কারণ এতে পুরুষ আকর্ষিত হতে পারে। (ফলে হাইহিল বা পায়েল জাতীয় অলংকার পরা নাজায়েজ।)

পুরুষ আর্কষিত হতে পারে এজন্য নারীকে কিভাবে সচেতন থাকতে হবে তা বলা হচ্ছে! কতটুকু হাস্যকর হতে পারে যুক্তিটা দেখলেই বুঝা যায়। যেমন ধরুন আপনার একটা বাড়ি আছে, সেই বাড়িটা দেখলে চোরের চুরি করার ইচ্ছে হতে পারে, তাই বলে কি আপনি বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলবেন অথবা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখবেন? চোর যেনো চুরি না করে সেই পরিবেশ তৈরি না করে উল্টোটা করা হচ্ছে!

• ৬. মহিলারা অবশ্যই গায়ে কোনো সুগন্ধী ব্যবহার করবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, “যে মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে এবং পুরুষদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সে অসতী”।

“যে মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে এবং পুরুষদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সে অসতী” অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। পুরুষ ইচ্ছে করলেই তা করতে পারবে এবং সে অসত হবে না। ইসলাম নারীকে শুধু পর্দা দিয়ে আটকে রাখতে চায় নি বরং যাবতীয় সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে আলাদা ভোগ্যপন্য করে রাখতে চেয়েছে।

• ৭. অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠ স্বাভাবিক থাকতে হবে। (আয়াত ৩৩.৩২)

এখানে কিন্তু অপরিচিত বলতে পরপুরুষ বা বাহিরের কাউকে বোঝানো হয় নি। বোঝানো হয়েছে রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কাউকে। অর্থাত মামা, খালু, দেবর এদেরকে। আর কণ্ঠ স্বাভাবিক বলতে স্পষ্টত আমরা বুঝি কামভাব না থাকা। নারীকে আবদ্ধ রাখার কতটুকু পরিকল্পনা থাকলে এমন শর্ত দেয়া যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!

• ৮. কোনো অফিস বা দোকানের ভেতরে কোনো মহিলাকে একজন পুরুষের সাথে একাকী রাখা যাবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, "একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে কখনই এমন কথাবার্তা হয় না যার মধ্যে শয়তান কু-কাজ না করে"।

মূলত নারীকে যাবতীয় সেক্স থেকে দূরে রাখার জন্যই এই পর্দাপথা তথা ‘হিজাব’। হিজাবের অর্ন্তনিহীত তাৎপর্য হচ্ছে কিভাবে নারীকে ‘কাম’ থেকে বিরত রাখা যায় তাই খুঁজে বের করা। একজন পুরুষ আর একজন নারী একত্রিত হলেই শযতানের কুমন্ত্রনায় তারা যৌন কাজে লিপ্ত হবে এমনটি ভাবার জন্য কত নিচু মানুষিকতার হতে হয় তা এই একবিংশ শতাব্দিতেও ভাবা যায় না।

• ৯. একজন নারী কখনও পুরষের সাথে হ্যান্ডশেক করতে পারবে না।

যেখানে নারীকে পুরুষের কাছাকাছিই আসার অধিকার দেয়া হচ্ছে না, সেখানে একজন নারী কি করে হ্যান্ডশেক করবে?

• ১০. এমনকি অন্যকোনো নারী বান্ধবীর বাড়িতেও সে তার পর্দা বা হিজাব খুলতে পারবে না কারণ সে ঘরের মধ্যে কোনো পুরুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। ইসলামের নবী বলেছেন, "যদি কোনো নারী তার নিজের বাড়ি বা তার স্বামীর বাড়ি ভিন্ন অন্য কোথাও তার পর্দা সরিয়ে ফেলে তবে সে সেই পর্দাটি সরিয়ে ফেললো যা তাকে খোদার সামনে নিজেকে রক্ষা করতো"।

একজন নারী অন্য একজন নারীর সামনেও পর্দা করতে হবে তাও লুকিয়ে থাকা পুরুষের ভয়ে? নারীর প্রতি কতটা নির্দয় হলে এমন আদেশ আসতে পারে বুঝায় যাচ্ছে।

• ১১. স্বামী বা যথোপযুক্ত আত্মীয়-সঙ্গী ছাড়া একজন স্ত্রী ত্রিশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব যেতে পারবে না।

নারীর দূরত্ব ও বেধে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ যে, আমাদের দেশে যখন কোনো নারী বাহিরে যায় তখন তার নিরাপত্তার জন্য ছোট বাচ্ছাদের দেয়া হয় যে নিজেই কিনা নিরাপত্তা কি বুঝে না। এই প্রথা দেখলে বুঝা যায় ইসলাম ধর্ম নারীকে কতটা দূর্বল ও অবিশ্বাস করে।

• ১২. একজন নারীর কখনও কোনো পুরুষকে অনুকরণ করা উচিত নয়।

নবী রা তো মহান। সবাই তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু নারীরা কি নবীদের অনুসরণ করতে পারবে? আর পারলে প্রশ্ন জাগে নবীরাও তো পুরুষ!


এই হল একজন নারীর ঘর থেকে বের হওয়ার নিয়ম। এখানেই শেষ নয়। আবার এই নিয়মেরও রয়েছে বিভিন্ন শর্ত। যা কোরান ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। চলুন সংক্ষেপে সেই শর্তসমূহগুলো দেখিঃ

• সমস্ত শরীর ঢাকা
• কারুকার্য ও নকশা বিহীন পর্দা ব্যবহার করা
• পর্দা সুগন্ধি বিহীন হওয়া
• শীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেসে উঠে এমন পাতলা ও সংকীর্ণ পর্দা না হওয়া
• পর্দা শরীরের রং প্রকাশ করে দেয় এমন পাতলা না হওয়া
• নারীর পর্দা পুরুষের পোশাকের ন্যায় না হওয়া
• সুখ্যাতির জন্য পরিধান করা হয় বা মানুষ যার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, পর্দা এমন কাপড়ের না হওয়া
• পর্দা বিজাতীয়দের পোশাক সাদৃশ্য না হওয়া

বুঝাই যাচ্ছে যখন এই নিয়ম-নীতি প্রণিত হয়েছিল তখন সেখানে কোনো নারীর অংশগ্রহণ দূরে থাকুক, তাকে পুরুষের মত মানুষ হিসেবেও কল্পনা করা হয় নি। যতদিক থেকে, যতভাবে নারীকে আবদ্ধ এবং শৃঙ্খল রাখা যায় তারই প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে শুধু নারীকে পোষাকের অভ্যন্তরে রাখার জন্য! অন্যদিক এবং অন্যান্য বাধা-নিষেধ তো রয়েছেই। আজকের আধুনিক সমাজে যখন দেখি কোনো সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধ্যান-ধারণা এবং চেতনা দিয়ে নারীকে পর্দা বা হিজাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখার দলগত এবং ব্যক্তিগত চেষ্ঠায় লিপ্ত তখন অবাক এবং প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠ তথা বিশ্ববিদ্যারয়ে যখন কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দলের অঙ্গ-সংগঠন ভয়-ভীতি এবং জোড় পূর্বক নারীকে বোরকায় আবদ্ধ করতে চায়, তখন আমাদের বিবেক থমকে যায়। এই একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের বাংলাদেশে চলছে নারীকে হিজাবের আবরণে আবদ্ধ করার প্রচেষ্ঠা। সময় এসেছে নিজেকে, নিজের সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস এর মোহ থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তি এবং বাস্তবতার আলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার।

আমি আমার বান্ধবীকে একজন মানুষ মনে করি। সে আমারই মত রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ। যে এই সমাজের আর সবার মত এবং যার রয়েছে সমাজের প্রতি মমতা। যে আমারই মত কখনো বা আমি তার মত করে স্বপ্ন দেখি। আর আমি যেমন আমাকে কখনো পরাধীন ভাবতে পারি না, কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানতে পারি না তেমনি আমার প্রিয়জনকে, আমার বান্ধবীকেও ভাবতে পারি না। ‘হিজাব’ বা পর্দাপ্রথা আমার কাছে দাসত্বের প্রতীক, অবরোধের হাতিয়ার। আর সঙ্গত কারণেই আমি চাইবো না আমার প্রিয়জন কিংবা আমার বান্ধবী শৃঙ্খলিত থাকুক, অবরোদ্ধ থাকুক। তাই আমি চাই না আমার বান্ধবী বোরকা পড়ুক।

মগজধোলাই ও আধুনিক মোল্লাতন্ত্র; প্রেক্ষিত বিশ্ববিদ্যায়

"Brain-wash of Shibir and Modern Fundamentalism: Perspective University"
নির্বাচিত কলাম
...প্রক্রিয়াধীন

সূর্য্যের সন্তান

The Son of the sun

...প্রক্রিয়াধীন

২০০৯ এর সেপ্টেম্বর এ আমার উপন্যাস “সূর্য্যের সন্তান” প্রকাশিত হয়।

দেহাত্ববোধক কবিতা

কবিতার বই

...প্রক্রিয়াধীন

চুমু খাওয়া যে দেশে অপরাধ

মুক্ত সংলাপের বই
...প্রক্রিয়াধীন

এই সময়ের গল্প

Story of in this time
...প্রক্রিয়াধীন

ছায়া আমি শরীর হবো

Shadow shall turn into Body
...প্রক্রিয়াধীন

২০০৭ সালের এপ্রিলে আমার প্রথম উপন্যাস “ছায়া আমি শরীর হবো” প্রকাশিত হয়। যার কাহিনী আবর্তিত হয় এক প্রেমিক জুটিকে নিয়ে। যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারছে না। কিন্তু মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। মেয়েটির গর্ভে বেড়ে ওঠা ভ্রুণটি সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতি-নীতি উপেক্ষা করে এই পৃথিবীর আলো বাতাসে আসতে পারবে কি না তার এক আলেখ্য। ফতোয়া, মোল্লাতন্ত্র, ইসলাম, আমাদের সমাজের গোপন ও অন্ধকার অধ্যায়ের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয় এই উপন্যাস।

বিদ্ধস্ত ছায়াসুন্দরী

অল্প কিছুদিনের মধ্যে বইটি আপলোড করা হবে।

পাখির বাসার মত মন


রাত দশটা। বাহিরে বৃষ্ঠি হচ্ছে। বীথিকা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুল বাথরুম থেকে বের হয়ে গলা খেকি দিলে তা বীথিকার কানে পৌঁছল। সে যেন নিজেকে খুঁজে পায়। তারপর সোজা হেঁটে ডাইনিং এর টেবিলে সাজিয়ে রাখা ডিনারের দিকে গেল। মৃদুল তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে রাতের খাবার খেতে এলো। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। ছোট্ট এ বাসায় মাত্র দুজন মানুষ। বিয়ের তিন বছর যাবৎ এরা এখানেই থাকছে। এখানে একটা বেসরকারী ব্যাংকে মৃদুল চাকরী করে। কিছু দিনের মধ্যে বীথিকারও স্থানীয় একটা কলেজে চাকুরী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। র্নিঝঞাট এই দম্পতি এখন পর্যন্ত কোন সন্তান নেয় নি। পরিবারকে তারা জানিয়ে দিয়েছে আরো একটু গুছিয়ে তারপর সন্তান নেবে। মৃদুল ও বীথিকার সেটেল্ট ম্যারেজ হলেও এরা খুবই পরিতৃপ্ত দম্পতি ছিল গতকাল পর্যন্তও!
কিন্তু আজ সকালেই একটা ঝামেলা ঘটে গেছে। বীথিকার কলেজ জীবনের এক বয়ফ্রেন্ড কি মনে করে মৃদুলের অফিসে আসে। যাওয়ার সময় কিছু ছবি ও চিঠি বীথিকাকে দেয়ার জন্য দিয়ে যায়। প্যাকেটের মুখ খোলা থাকায় মৃদুল তা খোলে দেখে। বাসায় ফিরে সে এক একটি ছবি ও চিঠি বীথিকার সামনে ছুড়ে মারে। বীথিকা এসব দেখে 'থ' বনে যায়! কাজল যতই আবেগ-প্রবণ ছেলে হউক এত বছর পর সে এই কাজ করতে পারে, তা বীথিকা কল্পনায় ভাবতে পারেনি। এদিকে বীথিকা কখনো তার প্রথম প্রেমের কথা মৃদুলকে বলেনি। আজ সে মৃদুলের কাছে কতটা নিচু হয়ে গেল_ ভাবতে ভাবতে তার মাথা আরো নিচে নেমে যায়। বিকালের ঘটনার পর থেকে মৃদুল তার সাথে একটি কথাও বলেনি। যে মৃদুল বাসায় ফিরে অফিসের সব ঘটনা না বলে থাকতে পারে না, সে কিনা আজ কোন কথা বলে বেরিয়ে গেল আর ফিরল এই এখন।
দুজন শব্দহীনভাবে রাতের খাবার শেষ করল। বেডরুমে মৃদুল পাশ ফিরে শোয়ে থাকে। কাজকর্ম শেষ করে বীথিকা রুমে যায়। সে বিছানার একপাশে বসে হঠাৎ ফুফিয়ে কেঁদে ফেলে। অনেকণ কাঁদতে থাকে। এক সময় কি ভেবে মৃদুল পাশ ফিরে বীথিকার কাঁধে হাত রাখে। জলে টলমল চোখে বীথিকা মৃদুলের দিকে তাকায়। তারপর অপরাধী দৃষ্ঠিতে বলে_ আমার ভুল হয়ে গেছে। মৃদুল একটু মুছকি হাসে। তারপর বীথিকার হাত তার হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে_ কোথায় ভুল করেছ, কলেজে নাকি আমার কাছে গোপন করে?
বীথিকা আস্তে করে মৃদুলের বুকে মাথা রাখে।

নির্জনতার স্বাক্ষর



আড়াই-তিন বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে একা একা খেলছে। উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে আর নিজ মনে কথা বলছে। পাশের বাসার দেওয়ারের ফাঁক দিয়ে হামিদা বেগম শিশুটিকে দেখছিলেন। তিনি শিশুটির চঞ্চলতায় মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। খেলতে খেলতে হঠাৎ শিশুটিরও নজর পড়ল হামিদা বেগমের উপড়। সে একটু লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসল। হামিদা বেগমও মিষ্টি করে হাসলেন। হেসে হেসেই জিজ্ঞেস করলেন,
- কি করছো তুমি?
শিশুটি তার হাতের ভাঙ্গা গাছের ডালটা দুলিয়ে দুলিয়ে হামিদা বেগমের আরো কাছাকাছি এগিয়ে এলো। কিন্তু কিছু বলল না। হামিদা বেগমের দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে থাকলো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- তুমি একা একা খেলছো বুঝি?
শিশুটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল।
- তোমার কি নাম? শিশুটি বেশ ¯^vfvweK হয়ে বলল,
- বাবা। আমার নাম বাবা। আমাকে তবাই বাবা নামে দাকে? হামিদা বেগম হেসে হেসে বললেন,
- তাই! তোমাকে সবাই বাবা ডাকে?
- হু। আমার কাকু বাবা দাকে, আব্বু বাবা দাকে, মামনি বাবা দাকে, আমার কুয়েল বাবা দাকে, আমার তাগলও আমাকে বাবা দাকে! হামিদা বেগম আবারো হাসলেন। হেসে হেসেই বললেন,
- তোমাকে ছাগলও বাবা ডাকে? শিশুটি আরো আগ্রহী হয়ে বলল,
- তবাই আমাকে বাবা দাকে। আমি তবার বাবা। হামিদা বেগম বললেন,
- আচ্ছা সবার বাবা, তুমি একা একা কি খেলছিলে?
- কেলতিলাম না তো। আমি আমার কুয়েলের তাথে কতা বলতিলাম। তুমি আমার কুয়েল দ্যাকবে? আমার দুই-তা কুয়েল আছে। দাঁলাও তোমাকে দেকাই, বলেই দৌঁড়ে কুয়েল আনতে চলে গেল। হামিদা বেগম বাউণ্ডারীর এপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।
উনারা এই বাসা ভাড়া নিয়ে উঠেছেন সপ্তাখানেক হল। ¯^vgx একটি বেসরকারী সংস্থা থেকে অবসর নেয়ার পর নিজেদের এলাকার gd¯^j শহরের এই বাসায় উঠেছেন। হামিদা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা বড়। বিয়ে হয়ে গেছে। ¯^vgxi বাড়িতে থাকে। তার বড় ছেলেটা বিয়ে করে চাকুরী সূত্রে বউ নিয়ে অন্য শহরে থাকে। ছোট ছেলে লেখা পড়া করে রাজধাণী শহরে। বাসায় হামিদা বেগম আর উনার ¯^vgxB থাকেন। তার ¯^vgx সারা জীবন চাকুরী করে সন্তানদের লেখাপড়া করানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেন নি। উনি আবার বই পাগল মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় উনার পাঠাগারে। বাড়িতে একাই থাকেন হামিদা বেগম। উনার বাসার পাশের বাসা হচ্ছে এই ছেলেটির। ওদের বাসার চারপাশেই দেয়াল দেয়া। শুধু হামিদা বেগমদের বাড়িওয়ালার কিছু অংশ বাঁশের বেড়া দেয়া। আর এই ফাঁক দিয়েই কথা বলছিলেন।
শিশুটি একটা খাঁচা নিয়ে বেড়ার ওপাশে এসে দাঁড়াল। হামিদা বেগমকে দেখিয়ে বলল,
- এই দ্যাকো আমার কুয়েল পাকি। তিনি পাখিগুলো দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,
- এটা তো ঘুঘু পাখি, কুয়েল বলছ কেন? সে প্রতিবাদ করে বলল,
- না, না, এতা আমার কুয়েল পাকি। তুমি তেন না। তারপর কুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল,
- এই কুয়েল, বাবা বল। বল না, বল, বাবা বল। পাখিগুলো কোন শব্দ না করায় সে হামিদা বেগমের দিকে একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিচু ¯^‡i বলল, - তোমাকে দেকে কতা বলছে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, অন্য দিন শুনবো। হামিদা বেগম এই কথা বলে হেসে সুন্দরভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা কুয়েলের বাবা, তোমাকে তো বাসার সবাই বাবা বলে ডাকে, কিন্তু বাহিরের মানুষ কি বলে ডাকে? সে ঝটপট উত্তর দিল
- আমা-দেল পেপারমামা (পেপারওয়ালা) পাপন তোনা বলে দাকে।
- আচ্ছা পাপন সোনা, তুমি একটু দাঁড়াও। আমি চুলায় তরকারী বসিয়েছি তো, সেটা দেখে আসি।
- আত্তা। পাপন সম্মতি দিল। হামিদা বেগম তার কাছ থেকে চলে এলেন। পাপন সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। বাসার ভেতর থেকে তার মা ডাকলে সে-ও চলে যায়। পাপনদের বিরাট বাড়ি। বাড়ির মেইন গেট সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। সম্ভবত পাপন বেড়িয়ে যেতে পারে এই জন্য। তাই পাপন ওদের ছোট্ট আঙিনায় হেঁটে বেড়ায়। তার বয়েসি আর কোন বাচ্চা এ-বাড়িতে নেই যার সাথে সে খেলা করবে। কিংবা কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা মানুষকেও দেখা যায় না পাপনের খবরদারী করতে। তাই সে একা একাই তার কুয়েল, ছাগলের বাচ্চা আর উঠোনের ছোট্ট বাগানের গাছগুলোকে নিয়ে একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে


তুলেছে। এখন অবশ্য তার জগতে আরেকজন যুক্ত হলেন। হামিদা বেগম। পাপন এদিকে এলেই বাঁশের বেড়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। হামিদা বেগমও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে দাঁড়ান। দুজনের মধ্যে কত কিছু নিয়ে কথা হয়। তিনি তন্ময় হয়ে পাপনের কথা শুনেন। তার কথা মুখে আটকে যাওয়ার ফলে যে নতুন নতুন শব্দ তৈরী হয়, তার অর্থ উদ্ধার করতে পেরে তিনি যেন কিশোরীদের মত হেসে কুটিকুটি হন। পাপনও মনের সুখে কথা বলে যায়। একদিন পাপন হামিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করল,
- তোমলা কোন বাতায় তাক? আমাদের চাদে উতলে তোমা-দেল বাতা দ্যাকা যায়? হামিদা বেগম বললেন,
- এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার পিছনের বাসাটাই আমাদের। পাপন বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে বলল,
- ও।
- তুমি আসবে আমাদের বাসায়? এ কথা শুনে পাপন খুবই খুশি হল। খুশিতে তার চোখগুলো জ্বল জ্বল করে উঠল। তার পরই হঠাৎ মুখ করুণ করে বলল,
- কি কলে আতবো?
হামিদা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আসলেই তো! কি করে পাপন আসবে? এত বড় দেওয়াল তার পক্ষে পেরুনো সম্ভব নয়। তাকে আসতে হবে মেইন গেট দিয়ে বেড় হয়ে সদর রাস্তা ঘুরে। কারণ এদের বাসার গেট হামিদা বেগমদের বাসার গেটের বিপরীতে। পাপনও কোন কথা বলছিল না। হামিদা বেগম নীরবতা ভেঙ্গে পাপনকে বললেন,
- পাপনসোনা, তুমি সত্যি সত্যি আমাদের বাসায় আসতে চাও?
পাপন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
- তাহলে তোমার আম্মুকে বল ছাদে উঠার জন্য। আমিও আমাদের ছাদের উপড় উঠব। দু-বাসার ছাদ একেবারে কাছাকাছি আছে। আমি তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে আসবো।
- তুমি আমাকে কোলে তুলে নেবে! তাহলে আমি আম্মুকে বলি। পাপন দৌঁড়ে বাসার ভেতর চলে গেল। হামিদা বেগম নিজেদের দু’তলা বাসার ছাদে উঠলেন। দু-বাসার ছাদই বিশাল। হামিদা বেগমদের বাড়িওয়ালার বিশাল ছাদে তিনি পাপনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কিন্তু সে এলো না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তিনি ভাবলেন, পাপনের মা হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। তাই আর নিয়ে আসেন নি। তিনি যে কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন তেমন ব্যবস্থাও নেই। তাছাড়া কখনো ও-বাসার কারো সাথে তিনি কথা বলেন নি। পাপন ছাড়া আর কাউকে চেনেনও না। ভেবেছিলেন আজ পরিচিত হবেন, কিন্তু পাপনকে নিয়ে কেউ এলো না।

পরদিন হামিদা বেগম বাঁশের বেড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু পাপনের দেখা পেলেন না। কাউকে পাপনের কথা জিজ্ঞেস করবেন তেমন কাউকে পেলেনও না। হামিদা বেগম দেখলেন পাপনদের বিশাল বাড়িতে লোক সংখ্যা একেবারেই কম। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল। তিনি আসেন কিন্তু পাপন আর আসে না। একদিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, দেখলেন পাপন তাদের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছে। তিনি হাত ঈশারায় পাপনকে ডাকলেন। পাপন হামিদা বেগমকে দেখে অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ আম্মু আম্মু বলে কেঁদে দৌঁড়ে বাসার ভেতর চলে গেল। পাপনের ভয় পাওয়া চোখ দেখে হামিদা বেগম প্রথমে অবাক হলেন। কিছুই বুঝতে পারলেন না। ভাবলেন, কি ব্যাপার ছেলেটা তাকে দেখে এত ভয় পেল কেন। তারপর হামিদা বেগমের একটু একটু করে মনে পড়ল, ছোটবেলা মা তাকে প্রায়ই সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, অপরিচিত মানুষ ডাকলে কাছে যেয়ো না। এরা ছেলেধরা। তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। সেই থেকে কোনো অপরিচিত মানুষ দেখলেই হামিদা বেগমের চোখগুলোও পাপনের মত ভয় পেয়ে এমন অদ্ভুত হয়ে যেত।

এক যুবকের বর্ষাযাপন



এই হচ্ছে সমস্যা! কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ সন্ত্রাসের মত বৃষ্ঠির আক্রমণ। নিজেকে বৃষ্ঠির কবল থেকে রার জন্য অন্যান্য পথচারীর মত আমিও একটি গাছের নিচে দাঁড়ালাম। হাতের কিয়ার ব্যাগটা মাথার উপর ধরে পিচঢালা পথে বৃষ্ঠি আছরে পড়া দেখতে লাগলাম। নির্জন এই রাস্তার আশেপাশে তেমন ঘর-বাড়ি নেই। দু পাশে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। শহরতলীর এই জায়গাটা যদি কতৃপরে নেক নজরে পড়ত, তাহলে একটা সুন্দর পার্ক হতে পারত। আমি কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে তাকিয়ে আছি বৃষ্ঠির দিকে। আমার মত আরো অনেকেই সুবিধামত জায়গা থেকে তাকিয়ে আছেন। এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম দুয়েকটি টোকাই ছেলেমেয়ে। এরা একবার বৃষ্ঠিতে ভিজছে আবার দৌঁড়ে গাছের নিচে আসছে। অন্য একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটি প্রেমিক জুটি পরস্পরকে এমন ভাবে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলেই বৃষ্ঠি কাউকে ছু মেরে নিয়ে যাবে! আরেকটি গাছের নিচে চশমাপড়া এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সম্ভবত বাজারের ব্যাগ। কখন বাসায় যাবেন, কখন রান্না হবে! আর তা নিয়েই তিনি মনে হয় চিন্তিত। এমন একটা পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে বৃষ্ঠির শব্দ ছাড়া কানে আর কিছুই আসছে না। এমন সময় একটা কার এসে ব্রেক কষে থামল। অপোরত সবার দৃষ্ঠি তখন কারের দিকে। গাড়ির দরজা খুলে বৃষ্ঠিতে নেমে এলো একজন পুরুষ। তার সাথে সাথে নামল পাঁচ-ছয় বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। আর মেয়েটির শেষে নামল শাড়ি পড়া এক সুন্দরী মহিলা। তারা আমাদের কাছ দিয়ে হেটে গিয়ে মাঠের ছোট্ট একটু খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।
আমরা অবাক হয়ে দেখছি একটি পরিবারের কর্মকাণ্ড। টোকাই ছেলে-মেয়েরাও কিছুণের মধ্যে এদের সাথে বৃষ্ঠি ভেজায় শরীক হল। মহিলাটি টোকাই ছেলেদের একজনকে কি যেন বলল, সে বৃষ্ঠির মধ্যে তরতর করে একটা গাছে উঠে গেল। দেখলাম গাছ থেকে অনেকগুলো কদমফুল নিয়ে নামছে। আমি এই প্রথম মাথার উপর থেকে কিয়ার ব্যাগ সরিয়ে দেখলাম একটা কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
চশমা পড়া ভদ্রলোক এরই মধ্যে কোন এক পরিচিত ব্যক্তির ছাতার নিচে শেয়ার করে চলে গেছে। রিক্সা পেয়ে চেপে বসেছে প্রেমিক জুটি। অন্যান্যরাও বৃষ্ঠি কমছে না দেখে কি করবে ভাবছে। আমি পেন্টটাকে ভাঁজ করে একটু উপরে তুললাম। কিয়ার ব্যাগটা মাথায় দিয়ে আবার রাস্তায় নামলাম। মেসে ফিরতে হবে। কাপড়-চোপড় বদলিয়ে কিছুণের মধ্যে আরেকটা টিউশনিতে যেতে হবে। আমি পা বাড়ালাম আর তখনই আমার সামনে পড়ল বৃষ্ঠিভেজা একটি কদমফুল। কদমফুলটা তুলে নিলাম। ফুলটা হাতে নিয়ে কেন যেন পিছনে ফিরে আবার ঐ দম্পতির দিকে তাকালাম। তারপর নিজের হাতের কিয়ার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আবারো হাটা ধরলাম।

suMon azaD | a writter for himself, a writter for all |

হেডম্যান





হেডম্যান

বিরাট অসঙ্গতির পর-
তুমি যাকে হেডম্যান নামে ডাকতে
দেখলে- প্রকৃতিজুড়ে সন্ধ্যা হলে
তারও মাথা নত হয়-
প্রথাগত ঝিলের কাছাকাছি।

* দেহাত্ববোধক কবিতা সিরিজের কবিতা

কেশবতীর গল্প




ডিপার্টমেন্টে নবীণবরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে।
মেয়েদের প্রেভিলিয়নের দিকে নজর রাখার দায়িত্ব পড়েছে প্রিতম, তৌসিফ আর মৃদুলের উপর। পিছন দিকে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছে আর মঞ্চের অনুষ্ঠান দেখছে। হঠাৎ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মেয়ের দিকে হাত তুলে প্রিতম বলে উঠল- বন্ধু, দ্যাখ ওই মেয়েটার কী লম্বা চুল! যাকে বলে একেবারে কেশবতী!
মৃদুল ওদিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় পাশের কোনো কলেজের, অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। তথাকথিত গেস্ট হবে আর কী! তৌসিফ একটু ভেবে বলল, না-রে, মনে হয় আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই, নতুন এসেছে। ঠিক ভালো ভাবে চিনতে পারতেছিনা। প্রিতম একটু ভেংচি মার্কা চেহারা করে বলে, আমাদের ভার্সিটির! আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের? তাও কী-না আমাদের চোখে পড়ে নি! কথাগুলো শেষ করে প্রিতম হাসলো। তৌসিফ আবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল- আরে, হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে এমন লম্বা চুলের একটা মেয়ে দেখেছি। প্রিতম ব্যাপারটা বাদ দেয়ার মত করে বলে, আচ্ছা বাবা দেখেছিস ভালো হয়েছে। এখন দেখা গেল মেয়েটা আমাদের দিকে ফিরে তাকালো এ্যাঁইয়া বড় বড় দু‘খানা দাঁত বের করে। তারপর ধর গিয়ে, চেহারাখানা একেবারে তেলেছমাতি বেগমের মত! কথা শেষ হতেই তিনজন একসাথে হেসে উঠল।
তৌসিফ আবার বলল, না-না, তার উল্টোটা হবে। মৃদুল তৌসিফের থুথ্নিতে ঝাঁকি দিয়ে বলল, তুমি তো মামা, মি. আশাবাদী! তৌসিফ থুথনি থেকে মৃদুলের হাত সরিয়ে বলে, হলে?
তখন প্রিতম হেসে হেসে বলে, তাহলে এই তিন বছরে যে অসাধ্য সাধন করতে পারিনি, তার জন্য আদা আর কোল্ডড্রিংক্স খেয়ে লেগে যাবো!
এমন সময় অন্য সারি থেকে একটি মেয়ে এসে কেশবতী মেয়েটির পিঠে হালকা করে থাপ্পর দিল। সে পিছন ফিরে তাকিয়ে হেসে বলল, আরে মৌলি তুই? মৌলি বলল, তোদের না নবীণবরণ? তুই ভিতরে যাস নি? কেশবতী জানায় অনুষ্ঠানে আসতে তার দেরী হয়েছে, তাই সে ভেতরে যায় নি।
তৌসিফ তখন দাঁত কটমট করে বলে, বলেছিলাম না মেয়েটাকে কোথায় দেখেছি। আমি ওকে ভর্তির সময় দেখেছি। তোমরা তো ভাবো আমি শুধু গুল মারি! এমন সময় প্রিতমের দিকে তাকিয়ে মৃদুল বলে, কেউ যদি লাইনে দাঁড়াতে না চাও তাহলে বলে দাও। মেয়েটা দেখছি জটিল সুন্দরী! প্রিতম কেশবতীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে, আর কেউ লাইনে আসতে চাইলে খুন-খারাপি হয়ে যাবে! তৌসিফ খুব আগ্রহী হয়ে বলে, চল্ তাহলে মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আসি। জুনিয়র আছে কোনো প্রবলেম নাই। প্রিতম বাঁধা দিয়ে বলে, না-না, এভাবে না। আগাতে হবে অন্য প্রসেসে। ওর পাশে দেখ বড় আপু একজন আছে। উনাকে ধরতে হবে। মৃদুল বড় আপুকে চিনতে পেরে বলে, আরে সোনালি আপু দেখি! দাঁড়া আমি উনাকে ডেকে আনছি।

সোনালি এসেই জিজ্ঞেস করলো- কিরে তোরা! বল কেন ডেকেছিস? তৌসিফ বলে, আপু ঘটনা তো একটা ঘটে গেছে। সোনালি মুছকি হেসে বলে, তা তো বুঝতে পারছি। তবে সেটা কী? মৃদুল জানায়, ওই যে আপনার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল না! ওই যে চুল লম্বা মেয়েটা! সোনালি আবার জিজ্ঞেস করে- হ্যাঁ, কী হয়েছে?
তখন প্রিতম আমতা আমতা করে বলে, না আপু, এখনো কিছু হয় নাই। তবে হওয়ার জন্যই আপনার আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন আর কী! সোনালি চোখ বড় করে বলে তাহলে এই অবস্থা! মেয়েটা কী এই বিল্ডিং এর?
সোনালির প্রশ্নের উত্তরে তৌসিফ জানায়, শুধু এই বিল্ডিং এর না, আমাদের ডিপার্টমেন্টেরও!
শুনে সোনালি মাথা দোলিয়ে বলে, তা ভালো। তবে আমাকে কী করতে হবে? প্রিতম জানালো, আপু, আপাতত নাম ও নাম্বারটা নিয়ে দিলেই হবে। সোনালি হেসে হেসে বলে- আপাতত আর ভাইতত যাই বল না কেনো, শুধু নামটা জেনে দিতে পারব কিন্তু নাম্বার না। জুনিয়র একটা মেয়ে, নাম্বার কীভাবে চাই! উত্তরে মৃদুল বলল, কী বলেন আপু! নামতো আমরাও জানতে পারব। আপনি কৌশল করে জাস্ট নাম্বারটা নিয়ে আসেন। প্রিতম একটু অনুণয়ের সুরে বলে, প্লিজ আপু! মৃদুল আবার যুক্ত করে- এই না হলে বড় বোন! ছোট ভাইদের যদি কোন উপকারই না করলেন! সোনালি একটু হেসে বলল, তোরা না! আচ্ছা দেখতেছি। তোরা একটু খাবার-দাবারের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখিস!
সবাই সমস্বরে, অবশ্যই! অবশ্যই! বলে উঠে।
ভাসির্টির ভেতর একটা পুরনো দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিতম। তার পাশে দেয়ালের উপর বসে আছে মৃদুল। তৌসিফ বসে আছে সামনের ব্রেঞ্চে। তার সাথে আছে ইনন ও পায়েল। মৃদুল তখন সবার উদ্দেশ্যে বলল, এই ছিল মুটামুটি গতকালের কাহিনী। এখন প্রিতম কীভাবে আগাবে তাই বলবে। মি. প্রিতম আপনি শুরু করেন। তার আগে তৌসিফ হাত তুলে বলে, আমার কিছু বলার আছে আজকের হাউজের সামনে। ইনন বলল, অনুমতি দেয়া হইল। আপনি বলিয়া বলিয়া যাইবেন না, বসিয়া থাকিবেন। তৌসিফ শুরু করে, যার নাম্বার পাওয়া গেল তার নামটার ব্যাপারে এই গরিবের একটু কৌতুহল আছে!
পায়েল টিপ্পনি কেটে জানতে চায়, আর কোনো ব্যাপারে নাই তো? তৌসিফ উত্তরে বলে, ওসব না হয় না-ই বললাম! আমি তার নাম নিয়ে দু‘চারটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম! শরীফা রাহমান টিয়া ; টিয়া কেনো? প্রিতম একটু ক্ষেপে যায়। বলে, ওই বেটা আমি ওর নামের আকিকার সময় ছিলাম নাকি? মৃদুল হেসে হেসে বলে, আবার শামসুর রাহমানের কোনো আত্নীয়-টাত্নীয় নয়-তো! তৌসিফ ভেটো দিয়ে বলে, এটা অবশ্যই না। কেননা, একজন কবি তার কারো নাম টিয়ে রাখবে না। পায়েল বলে, রাখতেও তো পারে। কবিরা তো একটু খেয়ালি হয়। তাছাড়া রবি ঠাকুর নিজের নাম রেখেছিলেন ভানু সিং। ‘সিং’ ব্যাপারটা কী অদ্ভূত! তৌসিফ আবার বলে, ময়না রাখলে তো ভালই হত। গান গাওয়া যেত- 'ও আমার ময়না গো...'
প্রিতম হেসে হেসে সায় দিয়ে বলে, অসুবিধা কী? এখন গাইবি- ও আমার টিয়া গো... সবাই হাসে।
ইনন প্রসঙ্গে নিয়ে আসে। বলে, আচ্ছা এবার বল কী প্ল্যান করলি? পটাবি কীভাবে? প্রিতম একটু নড়েচড়ে আরাম করে দাঁড়িয়ে বলে, আমি তাহলে তোদেরকে ব্যাপারটা বুঝাচ্ছি। ৩ মাসের একটা এসএমএস প্রজেক্ট। তিন গুণ ত্রিশ = ৯০ টা এসএমএস করবো। ফোন করব শুধু বিশেষ দিনগুলোতে। তবে প্রথম ফোন করব এসএমএস পাঠানোর ঠিক এক সপ্তাহ পর। দম নিয়ে আবার বলে, তোদের যার কাছে যা যা এসএমএস আছে দিস। আশা করছি তিন মাস পর তোদেরকে তোদের ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো! মৃদুল হেসে বলে, এমন পিকিউলিয়ার প্ল্যান কেনো বাপ? প্রিতম জানায়, আসলে আমি চাই আগে কথাবার্তা হউক। দুজন দুজনের সম্পর্কে কিছু জানি। দেখি সে কারো সাথে এঙ্গেজ কী-না? চোখের দেখাটাই তো আর সব না! পায়েল যোগ করে, তাই! চুল তো আর চীরদিন না-ও থাকতে পারে, বাট মন থাকবে। ইনন চোখ ইশারা করে বলে, জটিল প্ল্যান! তবে বন্ধু! আমার মনে হচ্ছে তুমি এইখানে ধরা খাবা! প্রিতম বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয়, দ্যাখেন মিস ডাবল প্রিপজিশন. আপনি নামের দিক দিয়ে বড়লোক হতে পারেন। কারণ আপনার নামে আছে জোড়া প্রিপজিশন মানে in আর on! কিন্তু আমার বাবাও কম না! অন্ততঃ একটা প্রিপজিশন হলেও নামের সাথে দিছে। ওই প্রিপজিশনের কসম! টিয়া আমারই হবে। প্রিতমের কথা শোনে পায়েল বলে, তুই কিন্তু জিদ করছিস! প্রিতম গায়ে না নিয়ে বলে, করলাম! এই মন্তব্যে ইনন হঠাৎ বলে উঠে, তাহলে ধর বাজি! প্রিতম বলে, এখানে আবার বাজির কী আছে? তৌসিফ জিজ্ঞেস করে, মামা সাহসে বুক কাঁপে বুঝি? প্রিতম জানায়, বুক কাঁপবে কেন! মৃদুল যোগ করে, যদি তুই সাকসেসের ব্যাপারে ওভার সিওর থাকিস- তাহলে হয়ে যাক! প্রিতমও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ওকে, আমার আপত্তি নেই! আগ্রহের সাথে ইনন বলে, ওকে! তাহলে আজ থেকে তিন মাস পর কোন এক চাইনিজে দেখা হচ্ছে সবার। দোয়া করি বিলটা যেন তোকে না দিতে হয়! আফসোসের সুরে পায়েল বলে, বেচারাকে চাপ দিস না ইনন! প্রিতম কিঞ্চিত রাগত স্বরে বলে, হোয়াট! তোদের জেলাস হচ্ছে বুঝি! তোদের পটাই নি বলে? পায়েল উত্তরে বলে, এই ক্ষমতা তোমার নাই মামা! প্রিতম- আচ্ছা দেখিস তাহলে! মৃদুল হিসেব করে বলে, তিন মাস মানে আজ নভেম্বরের ১৪ তারিখ আগামী ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখ। তৌসিফ চেঁচিয়ে বলে, তার মানে ভ্যালেন্টাইন্স ডে! প্রিতম খুশি হয়ে ওয়াও উচ্চারণ করে উঠে। তারপর বলে, আশা করছি তোদের বিমুখ করব না।
ইনন বলে- আমরাও আশা করছি বিমুখ হব না!
পরদিন থেকে প্রতি রাতে দশটায় নিয়ম করে নতুন একটা মোবাইল থেকে প্রিতম নিয়মিত ভাবে এসএমএস করতে থাকে। আর ক্যাম্পাসে টিয়ার সহপাঠি কিংবা তার নিজের বন্ধু-বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করে টিয়া সম্পর্কে জানতে থাকে। এই জানার পাশাপাশি সে মুটামুটি রুটিন করে টিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে থাকে। লাইব্রেরী, ক্যান্টিন, ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ যেখানে তাকে পাওয়া যায়; প্রিতম সেই সকল জায়গায় আনাগোনা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে কাস আর কাসমেটদের সাথে একটা ছোটোখাটো গ্যাপ তৈরী হয়। বন্ধু-বান্ধবরা অনেকে টিজ করে বলে, এক সপ্তাহেই এই অবস্থা! পরে তো দেখছি আমাদের একেবারে ভুলে যাবি রে প্রিতম। তবে এক সপ্তা টানা কাটায় কাটায় দশটার সময় এসএমএস করেও কোনো সারা পায়নি সে। তার মোবাইল অন থাকা সত্তে¡ও কখনো কোনো এসএমএস করেনি টিয়া অথবা মিসডকল কিংবা কল। প্রিতম ভাবে মেয়েটা বড় কঠিন! একে পটাতে বেগ পেতে হবে নিশ্চিত। তারপরও সে হাল ছাড়ে না। সে ডিটারমাইন্ড হয় তিন মাস এসএমএস এর ব্যাপারে। এভাবে এক সপ্তা পর প্ল্যান মোতাবেক একদিন রাতে এসএমএস না করে দশটার এক ঘণ্টা পর অর্থাৎ ঠিক এগারোটায় ফোন করে প্রিতম।

_: হ্যালো! স্লামালাইকুম।
-) কেমন আছেন? সালামের উত্তর না দিয়ে প্রিতম জিজ্ঞেস করে।
_: ভালো আছি, কিন্তু আপনি কে? টিয়ার প্রশ্ন।
-) আমি সে, যে প্রতিদিন রাত দশটায় আপনাকে এসএমএস করে।
_: তা-তো নাম্বার দেখেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনি এসএমএস করেন কেন? আর ফোন-ই বা করলেন কেন? আমি সাধারণত অপরিচিত নাম্বার রিসিভ করি না এবং কথা বলতেও আগ্রহ পাই না।
-) ওকে! আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। আমার এসএমএস গুলোর শেষ অক্ষর দেখে হয়তো নাম জেনে গেছেন; তার পরও বলছি- ‘Pretoom’
_: তো! ও-পাশ থেকে সংক্ষিপ্ত উত্তর।
-) তো-কিছু না। ভাবছি নামটা ÔWorld name championship’ এর জন্য পাঠাবো। আপনার কাছে কেমন লাগল; তা-ই জানতে চাচ্ছিলাম আর কি! প্রিতম হেসে উত্তর দিল। আ...চ্ছা! উত্তরটা পেয়ে গেলাম। যাই হউক, রেখে দিই। চুলায় কিছু চড়িয়েছেন বুঝি?
_: আপনি তো বড় অদ্ভূত! চুলায় কি চড়াবো?
-) না। যে ভাবে তাড়াহুড়া করছেন তাই ভাবলাম...
_: হ্যাঁ, চুলায় চাল বসিয়েছি। এখন তরকারি কুটব, মাছ বানাবো, রাঁধবো, খাবো এবং ফোন রাখবো। ok!
-) ok, রাখেন। তবে মাঝে মধ্যে মাংস-টাংস রাঁধেন কী-না খুঁজ নেব।
_: never-ever! আমার নাম্বারে পরিচিত ছাড়া কেউ ফোন দেয় না এবং আমি অপরিচিত নাম্বার রিসিভ করিও না। সুতরাং...
-) কই, আপনার নাম্বার দেখে তো মনে হচ্ছে না এটা শুধু পরিচিতজনদের জন্য! আমার কল তো গেল। তাছাড়া আপনার অভিবাবক দেখছি বেশ কট্টরপন্থি!
_: আমার বাবা কখনো এমন না। এ রকম মন্তব্য কখনো করবেন না।
-) আসলে অন্য অভিবাবকের কথা mean করছিলাম!
_: এর বাহিরে কোনো অভিবাবক থাকুক; এটা আমি পছন্দ করি না।
-) Fine কিন্তু well wisher অথবা Partner এর ক্ষেত্রে ?
_: ভেবে দেখিনি অথবা বলতে পারেন আগ্রহ নাই।
-) কারণটা জানতে পারি?
_: না, পারেন না।
-) ok! কিন্তু চালের কনডিশনটা তো জানতে পারি?
_: (ও-পাশ থেকে হাসির শব্দ আসে।)
-) তাহলে ভালো থাকবেন।
_: ok।
-) বাই। লাইন কেটে গুণগুণ করে গান ধরে প্রিতম।
‘ওরে আমার টিয়া পাখি চিননা আমারে, তুমি চিননা আমারে। যে জন তোমার মন জিতিবে এসএমএস করে, তুমি চিননা তারে।’
এভাবে আরো কিছুদিন কথা বলে, বিভিন্ন জায়গায় স্বতঃস্ফুর্ত টিয়াকে দেখে এক সময় প্রিতমের সিরিয়াসলি ভালো লেগে যায়। আর প্রিতম যেহেতু চায় না টিয়া তার কোনো কারণে বিরক্ত হউক, তাই সে যখন-তখন ফোন কিংবা সরাসরি দেখা করে না। শুধু আড়াল থেকে, কখনো চলতি পথে, লাইব্রেরী, ডিপার্টমেন্ট কিংবা ক্যান্টিনে দেখে নেয়। টিয়ার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে মিলিয়ে এগোতে থাকে প্রিতমের ভার্সিটির দিনগুলো। অথচ সামনে তার অনার্স ফাইনাল। কিন্তু কাসের প্রতি অমনোযোগি। তাই কাসমেটদের সাথে বেড়ে যাচ্ছিল দূরত্ব। এই কয়দিনে কেমন পাল্টে গেছে প্রিতম। তার বন্ধুরা এই ব্যাপারটা মার্ক করে, জানতে চায় তার কী হয়েছে। ইনন তো একদিন বলেই ফেলল, এখনই যে অবস্থা! টিয়াকে পেলে তো আমাদের চিনবি নারে প্রিতম। প্রিতম হাসে। সে ভাবে কীভাবে বুঝিয়ে বলা যায় টিয়াকে তার মনের কথা। এর ভেতর একদিন এসএমএস এল টিয়ার। সে যে কী খুশি, পারলে লাফায়। বার বার পড়ল সেটা।
টিয়া লিখেছেÑ ‘ আপনি অনেকদিন যাবৎ প্রতি রাতে দশটায় এসএমএস পাঠান। ব্যাপারটা ইন্টারেসটিং। কিন্তু আমি ইন্টারেস্ট পাই না। আমি চাই, আপনি আর আমাকে কখনো এসএমএস করবেন না। কখনোই না।’
এই অসম্মতিমূলক এসএমএস টা-ই প্রিতম তার মেসের সকলকে দেখায়। তার কেনো যেনো মন খারাপ হয় আবার আনন্দও হয়। সে ওই হিন্দি ডায়লগটার মত ভাবে, ‘নাফরাত্ হি সাহি, লেকিন কুচ তো কিয়া’ তখনই সে টিয়াকে ফোন করে।

_: হ্যালো। কে? ও-পাশ থেকে জবাব আসে অপরিচিতের মত।
-) চেনেন না? প্রিতম ঠাণ্ডা গলায় জানতে চায়।
_: আপনার তো ফোন করার কথা না।
-) আপনারও তো এসএমএস করার কথা ছিল না।
_: কী চান আপনি? হোয়াট ইউ ওয়ান্ট?
-) ‘সীতা কার বাপ’ জানতে চাচ্ছেন?
_: দেখুন, আপনাকে তো বারবার বললাম, আমি এসবে আগ্রহী নই।
-) কিন্তু বন্ধু হতে আপত্তি কোথায়?
_: আছে। কারণ, এখান থেকেই দুর্বলতার শুরু।
-) আমি অনেকগুলো মাল্টিভিটামিন দিয়ে দেব; দুর্বল হবেন না।
_: সমস্যা আছে। আমি দুনিয়ার সবার সাথে বন্ধুত্ব করলেও আপনার সাথে করব না।
-) আমার অপরাধ?
_: বললাম না সম্ভব না।
-) ok, এই কথাটাই সরাসরি শুনতে চাই।
_: না। কী দরকার...
-) একই ডিপার্টমেন্টে আছি। তাছাড়া আমাকে তো চিনেন-ই মনে হয়। এত ফলো করি!
_: দেখা হলে কী বলতে হবে?
-) যা খুশি।
_: তাহলে কাল বিকালে ডিপার্টমেন্টে থাকবেন। আমি পরীক্ষার পর দেখা করব।
চৌদ্দ তারিখ ২টার দিকে প্রিতম পৌঁছে যায় চাইনিজে। সেখানে আগে থেকেই ছিল মৃদুল, তৌসিফ, পায়েল। শুধু ইনন তখনো আসেনি। মৃদুল বলে, খিদায় পেটের ভিতর চুচু তার ফুল ফ্যামেলি নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি অর্ডার দে। তৌসিফ ও বলে, আমার পেটেও দাউ দাউ করি আগুন জ্বলতেছে। আস্ত মুরগ দিলেও সেটা সেদ্ধ হয়ে যাবে। হারি আপ ম্যান। প্রিতম জিজ্ঞেস করে, ইনন আসার আগেই অর্ডার করবি? পায়েল বলে, তোরা মেনু দেখ আমি ইনুকে কল দিচ্ছি। অর্ডার শেষে সবাই মিলে গল্প করছে। প্রিতম বলছে, শেষ পর্যন্ত একজনকে মন দিয়ে অনুভব করেছিলাম কিন্তু সে বুঝল না। আমার ইমিডিয়েট বড় বোন মাস্টার্স করছে স্থানিয় একটা কলেজ থেকে তা তো তোরা জানিস। তা না হলে বাসায় বলতাম, টিয়ার বাসায় প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। বাই আই হ্যাভ সাম লিমিটেশন! মেয়েটা বুঝল না। ভ্যালেন্টাইন্স ডে এখন আমার কাছে প্রতি বছর কারো স্মৃতি নিয়ে আসবে। যা দুঃখে থাকবে Full fill। সবাই প্রিতমের কথা শুনে মন খারাপ ভাব নিয়ে মাথা দোলাচ্ছে। খাবার নিয়ে আসছে দেখে প্রিতম মোবাইল থেকে ইননকে কল দিল।
_: হ্যা, প্রিতম!
-) ইনন, কই তুই? খাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!
_: আমি তোর পিছে। একথা শুনে প্রিতম পেছন ফিরে তাকায়। দেখে ইননের সাথে টিয়া। সে তো অবাক! কিছু বলার আগেই মিটিমিটি হেসে টিয়া বলে, বন্ধুদের খাওয়াবেন, আমাকে খাওয়াবেন না? প্রিতম উঠে চেয়ার ছেড়ে জায়গা করে দিতে দিতে ইননের দিকে তাকিয়ে বলে, ই...নু!
ইনন বলে, বন্ধু আসলেই হেরে গেছি আমি। টিয়ারও তোকে ভালো লাগে। বাদ-বাকী ইতিহাস টিয়া তোকে পরে বলবে। এখন খাওয়া শুরু করা যাক।
খাবার আগে এক তোড়া ফুল টিয়ার হাতে দিয়ে প্রিতম বলে, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে! সাথে সবাই রিংয করে। খাওয়া শুরু করতে করতে ইনন বলল, হ্যাঁ প্রিতম, তোকে একটা কথা বলা হয় নি; তা হচ্ছে, টিয়া কিন্তু আমার রুমমেট! প্রিতম যেনো বেকুব বনে যায়। অবাক হয়ে বলে, তার মানে? হলে তোরা এক সাথে থাকিস! তারপর মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল, ও মাই গড! এভাবে ধরালি আমাকে! ‘কেশবতীর গল্প’ তাহলে তোরাই ডিরেক্ট করলি? সঙ্গে সঙ্গে সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল।

তার সঙ্গে সঙ্গে যেন এক মায়াবী ঝংকারে কেঁপে উঠল রেস্তুরার চারপাশ।

মনমিতা




কয়েকজন বন্ধু ক্যাম্পাসের এক কোণায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। ভার্সিটির এই জায়গা থেকে সবকিছু দেখা যায় আবার আড্ডাও দেয়া যায়। তখন নাসিম কনককে বলে, ঐ দেখ শীলা। নাসিমের কথা শুনে সবাই সেদিকে তাকায়। মাসুদ বলে, শীলা মনে হয় কনককেই খুঁজছে। তবে এদিকেই আসবে; এটা নিশ্চিত। সে এমন ভাবে কথাগুলো বলে যে কথা শেষ হওয়ার পর সবাই মুখ টিপে হাসতে থাকে। কনক কিছুটা লজ্জা পায়। বলে, আমাকে কেন? শীলা তো তোদেরও খুঁজতে পারে। সে তো সবারই ক্লাসমেট। আফসার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- তা ঠিক। তবে ভাইয়া কিঞ্চিৎ ব্যবধান আছে যে! শীতল আগ্রহী হয়ে জানতে চায়- ব্যবধান মানে! বুঝলাম না তো? ততোক্ষণে শীলা এসে গেছে। বসতে বসতে শীতলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি বুঝলি না? শীতল কিছু বলতে যাচ্ছিল কনক তাকে থামিয়ে বলে, আরে শীলা তুইও বুঝিস না। শীতলের দিকে ইশারা করে বলে, ওতো একটা টিউব। সব সময়ই একটু পরে জ্বলে। সবাই কনকের কথা শোনে হেসে উঠে। কনক শীলাকে বলে, তুই কি হেডের সাথে দেখা করেছিস? হেড তো বাত্তি জ্বালাইয়া তোরে খুঁজতেছে। শীলা ঠোঁটে কামড় দিয়ে বলে, ইসরে আমার একদম মনে নেই। আচ্ছা, স্যার কেন খুঁজছে জানিস কিছু। লতাও শীলার মত সিরিয়াস হওয়ার ভান করে কনককে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ! তুই কিছু জানিস? লতার কথায় শীলা ও কনক ছাড়া বাকীরা সবাই হিঃ হিঃ করে হেসে উঠে। এতে শীলা একটু লজ্জা পায়। তারপর ¯^vfvweK হবার জন্য বলে, মানে তোরা কেউ কিছু জানিস নাকি? নাসিম বলে, আমরা শুধু জানি হেডে তোমারে বুলাইছে। ক্যান বুলাইছে হেউডা হেডেই ভাল বলতে পারবে। তাই না? বলে মাসুমের দিকে তাকায়। মাসুমও মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানায়। শীলা একটু চিন্তা করে বলে, স্যার আমাকে নিশ্চিত বকবে। এ কথা শুনে আফজাল বিজ্ঞের মত মন্তব্য করে, স্যার কাউকে ডেকেছেন আর বকেন নি- এমন তো কখনো হয় নি! মাসুমও আফজালকে সমর্থন করে বলে, তুই ঠিকই বলেছিস। কেউ যদি একশতে একশ পায় আর স্যার তাকে ডেকে নেন, তবে নিশ্চিত যে তাকে ধমকিয়ে স্যার বলবেন, তুমি কেমন স্টুডেন্ট বলতো, আরেকটু সিরিয়াস হতে পারলে না? নিজের কথা শেষ করে মাসুম নিজেই হাসে। শীলা দুঃখি দুঃখি হয়ে বলে, আমি বুঝতে পারছি না। কনক, তুই চল না আমার সাথে। প্লিজ! শীলার কথা শোনে কনক অপ্রস্তুতের মত চেয়ে থাকে। তখন লতা বলে, যা না কনক, বেচারী একা একা যেতে ভয় পাচ্ছে। তোর যাওয়া উচিৎ। আফসার সুর মিলিয়ে বলে, শুধু উচিৎ নয় কর্তব্যও বটে! শীলা আবারো উঠতে উঠতে তাড়া দিল কনককে। নাসিম কনকের পিঠ চাপড়ে বলে- যাও মামা, যাও! সবার দিক থেকে চোখ সরিয়ে শীলার দিকে তাকিয়ে কনক বলে, চল। ওরা যখন চলে যাচ্ছিল তখন শীতল চেচিয়ে বলে, ভোল্টেজ ঠিক থাকলে টিউব একদিন ঠিক সময় জ্বলবে। কনক পিছন ফিরে শীতলের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে চলে যায়।

হেডের রুমে দুজন চুপচাপ বসে আছে। স্যার হাতের কাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করেন, তা কনক তুমিও ওর সাথে এসেছো। ভাল। কনক বলে, স্যার আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। স্যার হু বলে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা এখন মাস্টার্স এ উঠে গেছ। এখনও যদি নিয়ম কানুন ভাল ভাবে না জানো, তা হলে কিন্তু বিরাট অন্যায়। শীলা বলে, স্যার, কি করেছি স্যার বুঝতে পারছি না। স্যার চেয়ারে হেলান দিয়ে বলেন, তুমি তোমার প্রপোজাল সীটের এক কপি অফিস থেকে নিয়ে গিয়েছিলে, কিন্তু এখনো তা ফেরত দাও নি। আমাকে অফিস থেকে ঘটনাটা জানালো। কারণ ওই বিষয়টা আমার ছিল। শীলা তৎক্ষণাৎ সরি স্যার বলে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে চাইলো। স্যার তাকে থামিয়ে একটু হেসে বললেন, দেখ ইংরেজরা আমাদের এই শব্দটা দিয়েছে বলে সব সময়ই তার ব্যবহার করতে হবে- তা কিন্তু ঠিক না। শীলা বলে, আমি আসলে স্যার জুনিয়র একটা মেয়েকে দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম জমা দিয়ে দেয়ার জন্য। স্যার একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, তাই বলে খবর নিবে না! তারপর কোমল ¯^‡i দু’য়েক দিনের ভেতর দিয়ে দেবার জন্য বলেন। কনক শীলার পক্ষে সাফাই করে বলে, দু'য়েক দিনের মধ্যে দিয়ে দিবে স্যার। আমরা তাহলে যাই স্যার। ওকে আবার এসো বলে স্যার তাদের বিদায় জানান।

কনক ও শীলা একই ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্স করছে। অর্নাসও করেছে এক সাথে একই বিষয়ে। অনার্সের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এরা খুবই ভাল বন্ধু। দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংও চমৎকার। বন্ধু-বান্ধবরা এদের সম্পর্ক নিয়ে শীলার আড়ালে কনককে আর কনকের আড়ালে শীলাকে ক্ষ্যাপায়। এদের আচরণে ভাল ভাবেই বুঝা যায় যে একে অন্যকে পচন্দ করে। কিন্তু দুজনই এমন চাপা ¯^fv‡ei যে কেউই এই ভাল লাগা প্রকাশ করতে চায় না। বন্ধুরা ব্যাপারটা অনেক দিন থেকেই দেখছে। তাই সবাই মিলে ঠিক করে, কিছু একটা করা দরকার। আর তাই সিদ্ধান্ত হয় সামনের ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে এই একবিংশ শতাব্দির ‘বুক ফাঁটে তো মুখ ফুঁটে না’ জুটির জন্য কিছু একটা করা হবে।

এক বিকেলে লতা আর নাসিম কনকের বাসায় যায়। তারা কনককে জানায় যে, আগামীকাল ভালবাসা দিবস উপলক্ষে সবাই এক হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেবে। সে যেন সকাল দশটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায়। আর শর্ত হচ্ছে সাথে মোবাইল নেয়া যাবে না। শর্ত শোনে কনক কারণ জানতে চাইলে লতা বলে, আমরা চাই একটা দিন অন্ততঃ এই চৌকিদার বিহীন কাটুক আমাদের। অর্থাৎ কিপ সাইলেন্ট আর কি!
ওদিকে শীতল আর আফসার যায় শীলার বাসায়। তারাও শীলাকে একই কথা বলে চলে আসে। কিন্তু নির্ধারিত দিনে দশটা বাজার আগে নাসিম চলে যায় কনকের বাসায় আর লতা যায় শীলার বাসায়। নাসিম পৌঁছে দেখে কনক মোটামুটি রেডি হয়ে আছে। সে কনককে বলে, দোস্ত ঘটনা তো ঘটে গেছে। যাইহুক, তুই যেহেতু শীলাকে কিছু বলিস নি তাই আর কিছু বলতেও যাস না। কারণ আজ নাকি শীলা তার প্রেমিকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে। শোন, তুই একদম ¯^vfvweK থাকবি। কোন ইমোশনাল কাজ-কারবার করতে যাবি না। কনক অবাক হয়ে বলে, তুই কি বলছিস! নাসিম বলে, আমি যা বলছি তা তুই একটু পরেই দেখতে পাবি। নিজেকে শক্ত রাখিস। আবার কনক বলে, আরে ধূর! আমি আবার ইমোশনাল হতে যাবো কেন? কিন্তু শীলা হঠাৎ... মানে কার সাথে... কনক বিড় বিড় করে। তখন নাসিম বলে, তুমি শালা চুপ করে থাকবা আর সে তোমার অপেক্ষায় বুড়ি হইবো; এইটাই চাইছিলা না? যাই হোক সবাই হয়তো পৌঁছে গেছে। তুইও সেখানে যা, আর শোন, যেহেতু ফুলগুলো কিনেছিস সাথে করে নিয়ে যা। আমি একটু পরে আসছি বলে নাসিম চলে যায়। এদিকে কনক যেন কিছুই বুঝতে পারে না। তবুও ঘোরলাগা মানুষের মত ফুলগুলো নিয়ে বের হয়।
ঠিক একই কাণ্ড ঘটে শীলার সাথেও।

রেস্টুরেন্টে কনক পৌঁছার সাথে সাথেই শীলাও চলে আসে। দুজন এসেই শুকনো হাসি হেসে ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। দুজনের হাতেই ফুল। কিন্তু কেউ কাউকে দেয় না। শীলা ভাবে কনক ফুলের তোড়া নিশ্চয় তার প্রেমিকার জন্য এনেছে। তাই তাকে দেয় নি। অসুবিধা কি সেও শক্ত মেয়ে। এই ফুলগুলো দিয়েই কনকের প্রেমিকাকে শুভেচ্ছা জানাবে। যতই কষ্ঠ হউক কনককে বুঝতে দিবে না। অপর দিকে কনক ভাবে, দেখ অবস্থা, কি সুন্দর করে সেজে এসেছে! হাতে আবার ফুলও! ভাল। আমিও শক্ত ছেলে ফুল নিয়ে এসেছি তো কি হয়েছে? এই ফুল দিয়ে তোর প্রেমিককে শুভেচ্ছা জানাবো। ভেবেছিস আমি ভেঙ্গে যাব, না ? এসময় দুজনের চোখাচোখি হলে আবারো শুকনো হাসি বিনিময় করে দুজন চুপচাপ বসে কোল্ডড্রিংসের অর্ডার দেয়।
ড্রিংস খেতে খেতে ভার্সিটিতে অতিবাহিত বিগত দিনের স্মৃতি মনে পড়ে দুজনেরই। একবার কনক কি কারণে যেন ক্যাম্পাসে আসছিলনা। মোবাইলও বন্ধ। শীলা তখন অনেক কষ্ঠে ঠিকানা জোগার করে কনকের বাসায় হাজির। সেই সময়ই কনক গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে। এসে দেখে তার মার পাশে বসে আছে শীলা। কনক অপ্রস্তুত হয়ে মাকে বলে, তোমাদের পরিচয় হয়েছে মা। মা মিটিমিটি হেসে বলেন, হ্যাঁ, ভাল করেই হয়েছে। এখনও শীলার কথা মাঝে মধ্যেই তিনি কনকে জিজ্ঞেস করেন আর বলেন, মেয়েটাকে তো আর নিয়ে এলি না। কনক ভেবেছিল বিয়ে করে নিয়ে যাবে, মা ও খুশিই হবেন। কিন্তু এখন! কোল্ডড্রিংস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একে অপরকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে আর দাঁত কটমট করছে। আবার চোখাচোখি হলেই মুখ রক্ষার হাসি দিচ্ছে। শীলার মনে পড়ে, একদিন সে লাইব্রেরী ওয়ার্ক করছিল। তাই মোবাইলও বন্ধ। কিন্তু কি একটা খবর দেয়ার জন্য শীলাকে খুঁজছে কনক। ইউনিভার্সিটির সব জায়গায় খুঁজে অবশেষে লাইব্রেরীতে এসে পেল। সামনে এমন ভাবে বসল যেন শীলা এখানে এসে মস্তবড় অপরাধ করেছে। রাগে কনকের সে কি অবস্থা! তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। বারবার জিজ্ঞেস করার পরও তাকে খুঁজার কারণ বলছিল না। পরে যখন অনেক অনুরোধ করার পর বলল তা শোনে মুখ বন্ধ করে শীলা হো হো করে হেসে উঠে।

শীলা কনকের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই গাধাটা আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারলো! তার চোখ টলমল করে উঠে। তাই সে বুঝতে পারে, এখানে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। সে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না। তার চেয়ে কনককে নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে যাওয়াই ভাল। ওদিকে কনক ভাবে কাউকে যদি তার ভাল লেগে থাকে তবে সে হচ্ছে শীলা। আর এই শীলাকে অন্যের সাথে দেখে কখনোই সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। তাই যা হবার হউক শীলাকে যে ভালবাসতো একথা বলে চলে যাবে। এমন সময় শীলা উঠে দাঁড়ায়, কনকও উঠে দাঁড়ায়। শীলা কনকের দিকে চেয়ে বলে, তোকে আমি কিছু বলতে চাই। কনক থামিয়ে বলে, তুই কিছু বলার আগে আমার কথা শোন। টলটল চোখে বলতে থাকে, এই জীবনে আমি এক জনের সাথেই মিশেছি, খুব আপন বলে জেনেছি। তাই ঠিক করেছি যা আছে কপালে হবে, তাকে আমি আমার ভাল লাগার কথা বলেই ফেলবো। হয়তো দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও । এতদিন না বলে যে ঠকা ঠকেছি আজ না বললে আর কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। একথা বলে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে শীলার ফুলসহ দুহাত চেপে ধরে মাথা নিচু করে আবারো বলতে থাকে, শীলা তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকেই ভালবাসতাম, ভালবাসি, ভালবাসবো। তারপর জলমগ্ন চোখ তুলে শীলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোর মনের মানুষকে এই ফুলগুলো দিয়ে শুভেচ্ছা দিস। তখন অবাক হয়ে শীলা কনকের হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলে, এসব তুই কি বলছিস? আমার মনের মানে? আমার মনের মানুষ তো তুই? তুই এসব কি বলছিস পাগলের মত?

এরকম একটা আবেগময় মুহূর্তে হাততালি দিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে তাদের বন্ধুরা। নাসিম চেচিয়ে বলে, সব কিছুর মানে আমাদের কাছ থেকে শোনো। তারপর বসতে বসতে আফসার জানায়, সবই ছিল আমাদের প্ল্যান! শীতল কনককে উদ্দেশ্য করে বলে, খুব তো আমাকে টিউব বলতি, আমার নাকি ভোল্টেজের ঘাটতি তাই দেরীতে জ্বলি। তোর তো পুরা ভোল্টেজ ছিল। তাহলে এত দেরী হল কেন জ্বলতে? শীতলের কথা শোনে সবাই হেসে উঠে। মাসুদ বলে, আর এই প্ল্যানটা না করলে তোমরা কোন দিনও প্রকাশ করতে না। আফসার তার সাথে যোগ করে, যে চাপা ¯^fv‡ei দুজন! কনক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে- তোরা না! কনকের একেবারে ঘনিষ্ট হয়ে চোখ মুছে হাসি হাসি মুখে শীলা বলে, থ্যাংকস, থ্যাংকস ফর অল। বন্ধুরা কনক ও শীলার উদ্দেশ্যে উচ্চ স্বরে বলে, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।

প্রিয়বই (উপন্যাস): ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ _মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়



‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে প্রবেশ করেছিলেন সাহিত্য জগতে। আর সেই মানিকের হাতেই রচিত হল কালজয়ী উপন্যাস; ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’!
মূলত: ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এই দুটি উপন্যাসই তাকে কিংবদন্তীর লেখকে পরিণত করেছে।
১৯০৮ সালের ১৯শে মে জন্মগ্রহণকারী মানিক ১৯৩৫ এ লেখালেখিতে প্রবেশ করেন। সেই বছরই আশ্চর্যজনক ভাবে মৃগী রোগ আক্রান্ত হন; যা ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। ‘৩৫ এ শুরু করে ‘৩৬ এ লিখে ফেলেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র মতো উপন্যাস। যদিও মাণিকবাবুর চেয়েছিলেন এর দ্বিতীয় খণ্ড লিখবেন কিন্তু তা আর হয়নি ১৯৫১ এর ৩-রা ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত!

একজন মাণিককে গভীর ভাবে পাওয়া যায় তার নিজ্ সৃষ্ঠ কর্মে।
বাংলা সাহিত্যের উল্লেখ্যযোগ্য সংযোজন এই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি।

আমি এই উপন্যাস এর গল্প কিংবা চরিত্র বিশ্লেষণে যাবো না। শুধু বলব, ফ্রয়েডের ‘লিভিডো’ আর সমাজতণ্ত্রের মন্ত্রে দ্বীক্ষিত মাণিকবাবুকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘শশী’। সদ্য ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে আসে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভিন্নতর সংস্কৃতি কিংবা সহজ ভাষায় উন্নত জীবনের সন্ধ্যানে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে আর প্রথাগত জীবনের বাহিরে যেতে পারে না।গ্রামীণ জীবণের প্রতিবেশ, পরিবেশের বৈচিত্র্যতা আর বাস্তবতার ডালপালা এমন ভাবে তাকে আকড়ে ধরে; যা ছিড়ে বের হওয়া শশীবাবুদের সামর্থের বাহিরে।
আমার কাছে সবচেয়ে অবাক লেগেছে যে, কোথাও মাণিকবাবু ‘শশী’কে জোড় করে আটকান নি।আর এখানেই একজন লেখকের স্বার্থকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মাণিকবাবুর স্বার্থকতা তথা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র প্রকৃত স্বার্থকতাই মিশে গেছে জীবনঘনিষ্ট মানুষগুলোর চরিত্রের পুংখানুপুংখ আখ্যান রচণায়।মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনবোধ, সমাজ চেতনা ও বিজ্ঞান মনস্কতার এক পরিপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে এই উপন্যাসটি।

আমার পছন্দের উপন্যাসের ব্যাক্তিগত তালিকাটি শুরু হয় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ দিয়ে।