আজকের কবিকে তাঁর নিজের উদ্দেশ্য ও কবিতার উদ্দেশ্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হয়। সে কবিতাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে কোথাও পৌঁছুতে চায় কি-না; এই প্রশ্নের মীমাংসা শুরুতেই করে নিতে হয়। অপর দিকে কেনো এবং কার জন্য লিখবে তা-ও নির্দিষ্ট করা জরুরি। কেননা, বাংলা কবিতা আজ এমন এক স্থানে পৌঁছেছে, যেখান থেকে সে কোনো অযাচিত কবি ও কবিতাকে তাঁর ছায়াতলে স্থান দিতে বাধ্য নয়। তবে, মিডিয়ার জন্য আজ এ ধরণের কবি ও কবিতা উভয়েরই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমি এই 'গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে' সমপ্রদায়টাকে শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা থেকে বিরত রেখে বাদবাকী কথাগুলো বলছি।
বাংলা কবিতায় বহু কবি তাঁদের যোগ্যতার স্বার রাখছেন এবং রেখে গেছেন। সেখানে যদি আর কোন প্রথাগত নতুন কবি, কবিতা না লেখেন; তবে মনে হয় না যে, বাংলা কবিতা অথবা বিশ্ব কবিতার খুব বেশী একটা তি হবে। আবার বছরের পর বছর ধরেও যদি কোন নবীন কবির স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর চিহ্নিত না হয়, তাহলেও নিশ্চয়ই খুব একটা আফসোস থাকবে না। কারণ, চর্যাপদের মাঠ পেরিয়ে বাংলা কবিতাকে দু'শ বছরের অনাবাদি জমিন পাড়ি দিতে হয়েছে।
তারপর মঙ্গল>মধুসূদন>রবীন্দ্র যুগ পেরিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের বিসতৃতি। সংেেপ তাই বলা যায়, বাংলা কবিতা তাঁর প্রধান কণ্ঠস্বরের জন্য অপো করতে জানে। শুধু মিডিয়ার দৌরাত্নে আমরাই অপো করতে ভুলে গেছি। প্রাপ্তির আকাঙ্খায় নিজের সৃজনশীলতায় কৃত্রিম 'তা' দিয়ে রাতারাতি ফুঁটিয়ে তুলছি আকাঙ্খার ডিম। অথচ বেমালুম ভুলে যাই_ সাহিত্যে প্রাপ্তি ও মূল্যায়ন সাধারণত একই সাথে হয় না। তবুও কেউ জনপ্রিয় বা বহুলপঠিত হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলে তাকে এই সত্য মাথায় রাখতে হবে যে, 'সত্যিকারের গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন উঁচুমানের মননশীল বই সাধারণত পাঠকপ্রিয় হয় না। সাধারণ পাঠকরা সেসব বইয়ের নাম জানেন, দূর থেকে শ্রদ্ধা করেন কিন্তু মননে কিংবা হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন না।'
(ভুমিকাঃ দৃষ্টিপাত/নাহিদ আহসান)
এটা অবশ্য সাধারণ পাঠকদের দোষ নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। সমাজের সব মানুষ যে সূ্ন অনুভূতি নিয়ে জন্মায় না; এই কথাটা রূঢ় হলেও সত্য। আর এই সত্যে বিশ্বাস রাখেন এমন পাঠক যেমন রয়েছেন, সাহিত্যিকও আছেন। সাহিত্য জগতে কোনো কোনো লেখক বিশেষ কোন শ্রেণীর পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করতেই পারেন। সেই লেখক যদি আজীবন এই একইভাবে বিশেষ শ্রেণীর পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করে সাধারণের কাছে দুবের্াধ্য রয়ে যান; সেজন্য ঐ লেখককে সাধারণের অপঠিত বলে মূল্যায়নে কারপন্ন করলে চলবে না। তবে, যাঁরা স্বভাবতই চিন্তাশীল, আত্নমগ্ন, কবি, তাঁরা চিরকালই নিঃসঙ্গ। তাঁরা অপ্রাপ্তির একটা ধারাবাহিক বঞ্চনা ভোগ করে যান জীবিতাবস্থায়। আর এইসব লেখককেই ধারণ করে লিটলম্যাগ। লিটলম্যাগের কণ্ঠ তাই চীরকাল-ই বিদ্রোহী।
খুব সম্ভবত, সচেতনভাবে এই বিদ্রোহী কণ্ঠের কোরাস বেঁজে উঠেছিল কল্লোলযুগে। কল্লোলে প্রকাশিত, 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, 'বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার কাজটি তিনি (রবীন্দ্রনাথ) অনেক বেশী কঠিন করে দিয়েছেন। একজনের বেশী রবীন্দ্রনাথ সম্ভব নয়; তার পরে কবিতা লিখতে হলে এমন কাজ বেছে নিতে হবে যে কাজ তিনি করেন নি; তুলনায় ুদ্র হলে_ হবারই সম্ভাবনা_ তাই নিয়েই তৃপ্ত থাকা চাই।" মধ্যযুগীয় অনাত্ন আবহকে অস্বীকার করে মধুসূদন দত্ত যেটুকু অগ্রসর হয়েছিলেন, তার তুলনায় তাঁর-ই আবহকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে মধুসূদনকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর অতিক্রমণের ধারায় কল্লোলযুগের উচ্চারণ ছিল, 'অন্ধভক্তির উপর আমাদের আর আস্থা নেই; আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞানকে। ভগবান, ভূত ও ভালবাসা_ এ তিনটি জিনিসের উপর আমাদের প্রাক্তন বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি।'
(বু:ব/অতি আধুনিক বাংলা সাহিত্য)
এই অস্বীকার প্রবনতার ফলে তিরিশের যে কবিতাবিপ্লব তার ধারাবাহিকতাকে গ্রহণ করে চলমান সময় পর্যন্ত এর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠিত চেতনাকে অতিক্রম না করে কোন ভাষাতেই নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটেনি। তবে, প্রতিষ্ঠিত চেতনাকে অতিক্রম করতে হলে কবিদের প্রথমত আত্নসত্তার প্রতিষ্ঠা তথা নিজস্ব স্বকীয়তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হয়।
আমার বিশ্বাস, কবিতা হচ্ছে সৃষ্টি ও নির্মাণ_ এই দু'য়ের সমন্বয়। কবিতা তৈরী হবে যুক্তি ও যাদুর সমন্বয়ে, এর শব্দ ব্যবহার প্রচলিত অর্থকে ধারণ করে কবিতাকে করে তুলবে ব্যঞ্জনাময়। কবিতার শব্দরা এক একটি অরচিত্র হয়ে
পাঠকের কাছে ক্রমাগত পৌঁছে দেবে সংকেতের পর সংকেত। সংকেত ও ইঙ্গিতের যৌথ বির্নিমাণে সৃষ্টি হবে কবিতা। এক এক সময় মনে হয় মিশেল ফুকো'র কথাটাই বুঝি সত্যি_ 'কবিতার পাঠান্তর ও জটিল বির্নিমাণের দ্বারা শিল্পের গোপন, লোকায়ত অবতল স্পর্শ করা যায়।'
এটা তো সর্বজনবিধিত যে, প্রত্যেক কবির কবিতায় ইনটুনেশন (নিজস্ব স্বরায়ন) প্রয়োজন। একে চিহ্নিত করা হয়তো সময়ের কাজ কিন্তু শুরুর প্রবণতা থাকা উচিৎ লেখকের মধ্যে। যদি পুরনো পথেই হেঁটে গেলাম, যদি অন্যের স্বরে কথা বললাম, অন্যের চোখে বিশ্ব দেখলাম_ তাহলে সেই বহুলচর্চিত অভিজ্ঞতা বয়ানের কি প্রয়োজন? তবে এ-ও হয়তো ঠিক নয় যে, স্বাতন্ত্রতা প্রকাশ পেলেই বড় মাপের কোন কিছু হয়ে যাওয়া যাবে!
কিন্তু এটাকে গন্তব্যে পৌঁছার সঠিক রাস্তায় হিসেবী পদপে হিসেবে নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা যায়।
মুঠোফোনের এই যুগে কবিরা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছেন অত্যাধুনিক আবিস্কারের সাথে। দ্রুতগতির যুগে সব কিছু বদলে যাচ্ছে দ্রুত। দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন। এখন মানুষ সব কিছুতেই ওই বিষয়টার নিযর্াস চায়। দিনদিন মানুষের ডিটেইলস এর প্রতি অমনোযোগিতা কিংবা অনাগ্রহ_ সাহিত্যেও প্রভাব ফেলছে। এর ফলশ্রুতিতে সাহিত্য বাজারে অণু'র আর্বিভাব। তবে এই পরিবর্তনের ফলে বাংলা কবিতা থেকে (কিছু অঞ্চলব্যাতিত) ন্যাকামি-টাইপ কথার্বাতা প্রায় বিদায় নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ১৯৫৪ সালের সেনেট হলে অনুষ্ঠিত দু'দিনব্যাপি কবি সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই কবি সম্মেলনের পর বাংলা কবিতায় সৃষ্টি হয়েছিল একটি প্রবণতা; আর তা হলঃ কাব্যপাঠ কবিকর্মের একটি অঙ্গ। চলল কিছুদিন। তারপর ভাব-ভাষার সোজাসুজি প্রকাশ ভঙ্গিটি ক্রমে কবিদের কাছ থেকে সরে আশ্রয় নিলো মিডিয়াবাজদের হাতে। আর তখনই কবিতা ভুল অর্থে হয়ে উঠল সামাজিক। তবে আজকাল সাবজেক্টিভ কবিতার র্চচা তেমন একটা হয়-ই না বললেও চলে। চারপাশের বহুর্মুখি অভিজ্ঞতা ও বিষয়ের বৈচিত্র্যতার ফলে সমকালীন (পরীণপ্রিয়) কবিদের কবিতায় চর্চিত হচ্ছে নিত্য-নতুন কনসেপ্ট। এর ফলে আধুনিক মন ও মনন বিশ্বায়নের ইতিবাচক সারায় মিলে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে, কবিতা পাঠককে (লেখক-পাঠক) কবিতা পড়তে হলে বসতে হচ্ছে অনেকগুলো চোখ নিয়ে।
আর এই এক একটি চোখ বহুদৃশ্য ধারণে সম।
এই সম চোখগুলোকে পুঁজিতে রেখে যারা অনুভূতির রাজ্যে সংকেত ও ইঙ্গিত নিয়ে নাড়াচাড়া করে আমি লেখালেখির েেত্র ঐ দলে থাকতেই স্বাছন্দবোধ করি। আর বিশ্বাস করি, কবিতা পাঠকরা কবিতাকে অনুভব করার জন্য মুটামুটি একটা প্রস্তুতিপর্ব পেরিয়ে অন্বেষণপর্বে নামেন। এই বিশ্বাস অল্পবিস্তর প্রায়োগিক হলেও; অমূলক নিশ্চয়ই নয়। কঠিন শব্দ দিয়ে কবিতা-শরীর গড়ার চেয়ে প্রচলিত ও পরিচিত শব্দের বুননে যে কবিতা রহস্যের চাদরে ঢেকে থাকে সে রকম কবিতার প্রতিই আমার আগ্রহ বেশী। কবিতা পড়ে অনুভূতির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া; হারিয়ে খুঁজে পাওয়া অথর্াৎ আবিস্কার-প্রবণতা রয়েছে এমন কবিতার প্রতি-ই ঝোঁকটা বেশী। যে সকল কবিতা পড়ে আবিস্কার করার মত কিছুই থাকে না কিংবা যে কবিতা চর্চায় রহস্যময়তা নেই, সে মত কবিতা চর্চায় অথবা পঠনে আমার আগ্রহ কম। কবিতার বিচারে অনুভূতি-ই হবে প্রধান নিয়ামক। আর এর প্রতিধ্বনিটা যেন নিজের কবিতায় শুনতে পাই সে দিকে ল্য রাখার চেষ্টা করি।
প্রকৃতির উপর মানুষের জয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা যে আত্ননির্ভশীল সমাজ-প্রক্রিয়া অতিক্রম করছি; সচেতনভাবে ল্য রাখতে হবে সেখানে যেন আবার কোন অদৃশ্য শক্তি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে না পারে।
এর দ্বারা পোস্ট করা
suMon azaD (সুমন আজাদ)
লেবেলসমূহ:
আলোচনা-সমালোচনা