পৃষ্ঠাসমূহ

রাষ্ঠ্রীয় সন্ত্রাসের আরেক শিকার লিমন, ক্রসফায়ার এবং র‍্যাব এর মানবাধিকার লংঘন

র‍্যাব এর ক্রসফায়ারে লিমন পা হারালো। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তার কিছুদিন পর লিমন সন্ত্রাসী নয় এমন একটা ঘোষণা র‍্যাব প্রধান এবং পুলিশের কর্তা ব্যাক্তিরা দিলেন। কিন্তু তার কিছু দিন পরই গণেশ উল্টে গেলো! শুরু হলো লিমনকে সন্ত্রাসী বানানোর প্রক্রিয়া। এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমন পা হারিয়ে সন্ত্রাসীর তালিকায় চলে এলো রাতারাতি। আর এই বিষয়টা নিয়ে মেতে উঠলো সবাই। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ সবাই একটি বিষয় নিয়েই ভাবছে। তাহলে কি নিরপরাধ লিমন র‍্যাব এর কাছ থেকে রেহাই পাবে না? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, একটা মিথ্যাকে ডাকতে হয় শত মিথ্যার অবরণে। এখন র‍্যাব এরও হয়েছে একই অবস্থা। লিমনকে গুলি করে শত মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাদের অন্যায়কে ডাকতে হচ্ছে। রাষ্ঠ্র চাইলে যেকোনো সন্ত্রাসী কাজকে জায়েজ করতে পারে আবার ভাল কাজকে সন্ত্রাসী কাজ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে পারে। মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে একটি গণতান্ত্রিক সরকার কতটা নির্লজ্জ হতে পারে লিমন তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ!
র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো নিরীহ লিমনের জন্য সবাই ব্যথিত। আমরা সবাই চিন্তিত রাষ্ঠ্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে। সারা দেশবাসী হতভম্ব সরকারী নৈরাচার দেখে।
কিন্তু র‍্যাব এর কাজকে বৈধতা দেয়ার এই উদ্যোগ নতুন নয়। র‍্যাব তৈরি করাই হয়েছে বিনা বিচারে মানুষ হত্যার জন্য। আমাদের দেশে মানবাধিকারের কতটুকু চর্চা হয় তা লিমনের বিষয়টি বিবেচনায় আনলেই বোঝা যায়। যেখানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান নিজে ফোন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বললেন যে, লিমন সুস্থ হওয়া পর্যন্ত যেনো হাসপাতাল তাকে ছেড়ে না দেয়, সেখানে পুলিশ এসে লিমনকে কিভাবে অসুস্থ অবস্থা কারাগারে নিয়ে যায়?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে লিমন যদি সন্ত্রাসী হতো, যদি র‌্যাবের দাবী মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোরশেদের সহযোগীই হতো কিংবা যদি সে মোরশেদই হতো তাহলে কি র‌্যাবের ক্রসফায়ার বৈধ হয়ে যেত? এই প্রশ্নটার মীমাংসা করা জরুরী কারণ মানুষ হত্যাকারী র‌্যাব কর্তৃক লিমনের পা হারানোর সাথে এর সম্পর্ক আছে। হত্যাকারীর একবার হত্যার নেশা পেয়ে গেলে সে হত্যা করতেই থাকে। র‌্যাব শুরু থেকেই তো মানুষ মারছে, পূর্ব বাংলা সর্বহরা পার্টি কিংবা অন্যান্য জনযুদ্ধের লাইনের নেতা-কর্মীদের মেরেছে, আমরা কিছু বলিনি। আজকে যে প্রথম আলো পত্রিকা লিমনের হয়ে দাঁড়িয়েছে সেও কিন্ত তখন র‌্যাবের সহোযোগী হিসেবে কাজ করেছে। একটার পর একটা চরমপন্থী সনাক্তকরণ অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছেপেছে আর র‌্যাব তাদেরকে সাবাড় করেছে। আমরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছি- যাক সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচা গেছে! র‌্যাব গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছিচকে সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন লেবেল লাগিয়ে, কালা-ধলা-মুরগী ইত্যাদি নানান শব্দ জুড়ে দিয়ে দমনের রাজনীতি করেছে, আমরা খুশি হয়েছি কারণ আমাদের কাছে “সন্ত্রাসীর আবার মানবাধিকার কি?”

আমরা কি কখনও প্রশ্ন তুলেছি- আচ্ছা র‌্যাব যে এদেরকে সন্ত্রাসী বলে ক্রসফায়ার করে দিচ্ছে, এরা কি আসলেই সন্ত্রাসী?
নাকি কারো শ্রেনী ঘৃণা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার? আমরা তো ধরেই নিয়েছি র‌্যাব মানে ফেরেস্তা বাহিনী, ফেরেস্তারা কখনো ভুল করতে পারে না! ব্যাক্তিগত-রাজনৈতিক-শ্রেণীগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হতে পারে না। তাই আমরা কখনো প্রশ্ন তুলেনি, আচ্ছা এভাবে কি সন্ত্রাস নির্মূল করা যায়? বিষবৃক্ষের গোড়া অক্ষুণ্ন রেখে বার বার ডালপালা ছাটলে যে বিষবৃক্ষ মরে না, বরং নতুন নতুন শাখা প্রশাখা গজায় সে কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম।

কিন্তু আমরা কেন এমনটা ধরে নিলাম? কেন আমাদের মনে একটুও দ্বিধা কাজ করলো না? কেন আমরা একটু সন্দেহও পোষণ করলাম না? তবে কি আমরা যে কোন মূল্যে স্বস্তি পেতে চেয়েছিলাম? আমরা কি ধরে নিয়েছিলাম “যে কোন কিছুর মূল্য”টা সব সময়ই অন্য কেউ দেবে? আমাদেরকে কখনই দিতে হবে না?

আমি অনেককে দেখেছি র‌্যাবের অপরিহার্যতা নিয়ে কথা বলতে, আমি নিশ্চিত এখনও অনেককে পাওয়া যাবে, যারা মনে করেন “সন্ত্রাসীদেরকে ধরে ধরে মেরে ফেলাই সন্ত্রাস নির্মুলের শ্রেষ্ঠ ও কার্যকর উপায়” সেই সাথে তারা এও বলবে, যে র‌্যাব হাজার হাজার “সন্ত্রসী” নির্মুল করেছে তাদের একটু আধটু ভুল তো হতেই পারে সেটা নিয়ে এতো হইচই করার কি আছে! তারা কখনও প্রশ্ন তুলবে না মানুষ হত্যাকারী র‍্য্যাব কেন বরাবার দূর্বলের ঘরেই হানা দেয়, কেন কোন গডফাদার বা রথী মহারথিকে ক্রসফায়ার করা হয় না?
এই যে শেয়ার বাজারের সূচনীয় অবস্থা, হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলো, ৬০ জনের কারসাজির কথা জানা যাচ্ছে, কই এদেরকে তো কখনও ক্রসফায়ার করা হবে না! হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট কারীদের এমনকি বিচারের আগে নাম না প্রকাশ করার কথা বলা হচ্ছে অথচ লাখ টাকার চাদাবাজদের ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার করে দিয়ে সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মুলের অভিনয় করা হচ্ছে! কি মজার ব্যাপার! আগুনে পুড়িয়ে শ্রমিক মারলে তো গার্মেন্টস মালিককে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়না, দশট্রাক অস্ত্রমামলার ব্রিগেডিয়ার-কর্ণেল আসামীদেরও তো ক্রসফায়ার হতে দেখলাম না, দেশের তেলগ্যাস সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার নায়কদের তো ক্রসফায়ার হয় না! যদি সত্যিকার অর্থে সমাজ থেকে সন্ত্রাস-দূর্নীতি-লুটপাট নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই র‌্যাব দিয়ে ক্রসফায়ার করানো হতো তাহলে তো শুরুতে বড় বড় গডফাদারদেরকে ক্রসফায়ার করাটাই স্বাভাবিক ছিল না? তা না করে, দেশের মধ্যে অস্ত্র কিংবা মাদক আমদানির মূল হোতাদের কে না ধরে, সীমান্তেই মাদক-অস্ত্র আসা বন্ধ না করে, ছোটখাটো অস্ত্রবাজ/মাদক ব্যাবসায়ীদের ক্রসফায়ার করা হলো, এতে সন্ত্রাস কতটা নির্মূল হলো?
নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্যকোনো উদ্দেশ্য?

আমরা বিষয়টাকে এভাবে দেখতে পারিঃ

১. অবাধ্য ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছিচকে সন্ত্রাসীদেরকে কিছুটা ঠাণ্ডা করা

২. গ্রেফতার করে বিচার করলে নাটের গুরুদের নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ার যে ঝুঁকি থাকে, রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের আসল চেহারা প্রকাশ হতে পারে, নাটের গুরুদেরকে সেই ঝুকি থেকে মুক্ত করা

৩. শাসক শ্রেণীর সন্ত্রাস দমনের নামে জনগনের কাছ থেকে বাহবা নেয়া

এক সময়ের বিপ্লবী রাজনীতির বাম সংগঠন তথা শ্রেণীশত্রু খতমের লাইনের সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীদের নির্মূল করার জন্য যে ক্রসফায়ার চালু করা হলো সে ক্রসফায়ার কি নিজেই “শ্রেণী শত্রু” খতমের লাইন না?
যার মাধ্যমে এলিট মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সমাজে শান্তির সাথে বসবাস ও লুটপাট চালাতে পারে?

কোন সমাজে-রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দুর্নীতি আকাশ থেকে পড়ে না, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। মানুষ মায়ের পেট থেকে সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থাই তাকে সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে বাধ্য করে। যে ব্যাবস্থা নাগরিকের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-কর্মসংস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ইত্যাদির কোন দায়দায়িত্ব নেয় না, যে ব্যবস্থায় গুটি কয়েক মানুষ বেশির ভাগ মানুষের শ্রম শোষণ করে আরামে আয়েশে থাকে, যে ব্যবস্থায় আইন-কানুন-পুলিশ-প্রশাসন গুটি কয়েকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে, যে ব্যবস্থায় পুঁজি যার মুল্লুক তার, সে ব্যবস্থা সন্ত্রাস দুর্নীতির জন্ম দেবেই। এই ব্যবস্থা বা সিস্টেমের প্রোডাক্ট/বাই প্রোডাক্ট “সন্ত্রাস-দুর্নীতি”।
এমনিতে ব্যবস্থার নাটের গুরুদের জন্য কোন সমস্যা না যতদিন না সেটা তাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে সেটার জন্য তো একটা রেডিমেড ব্যবস্থা থাকা লাগে: র‌্যাবের ক্রসফায়ার হলো সেই রকমই একটা ব্যবস্থা। সন্ত্রাস-দূর্নীতিতে জনগন অতিষ্ঠ হয়ে গোটা সিস্টেমটাকে যেন টালমাটাল করে না দেয় তার জন্য সিস্টেমরই একটা রক্ষা কবচ এই ক্রসফায়ার সিস্টেম। আমরা যতদিন এই সত্যটা বুঝে সত্যিকার অর্থে র‌্যাব ও তার ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে রুখে না দাড়াবো, ততদিনই “যে কোন মূল্যে” তথাকথিত সন্ত্রাসী দমন চলবে। এর আগে এই “যেকোন মূল্য” সর্বহারা মোফাক্খারুল-টুটুলরা দিয়েছে, এখন দিচ্ছে নিরীহ দিনমজুর লিমনরা, কিন্তু একদিন সাহিত্যিক-লেখক-ভিন্নমতাবলম্বীরা, সুশীল সমাজের ধারকরা, নিরাপদে থাকা কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীসহ গোটা দেশের মানুষকে এর চরম মূল্য দিতে হবে। এই ক্রসফায়ারে বিনা বিচারে হত্যার যে রীতি প্রচলিত হয়েছে তার মূল্য দিতে হবে সবাইকে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ক্রসফায়ার সিস্টেমের সমালোচনা করে বলেছিলেন, “প্রকৃতি অতি যত্ন নিয়ে একটি মানব সন্তানকে জন্ম দেয়। অনেকটা সময় নিয়ে এই প্রকৃয়া চলে। হঠাৎ করে বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলা কোনো সিস্টেম হতে পারে না।“ আজ আমাদের লিমনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিৎ। এখনই যদি সচেতন না হই তাহলে বিনা বিচারে হত্যার এই প্রকৃয়া “ক্রসফায়ার” এর জন্য একদিন চরম মূল্য দিতে হবে জাতিকে।