পৃষ্ঠাসমূহ

স্বর-সন্ধানী কবি জফির সেতু'র ঃ "সহস্র ভোল্টের বাঘ"

[সহস্র ভোল্টের বাঘ। জফির সেতু।
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০৬।
প্রকাশকঃ শুদ্ধস্বর, ঢাকা।
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা।
মূল্যঃ পঞ্চাশ টাকা।]

সহস্র ভোল্টের বাঘ!
সাধারণত বাঘ বলতেই আমরা তেজদীপ্ত, সাহসী ও শক্তিশালী কোন কিছু ভেবে থাকি। আর সেই বাঘ যদি হয় সহস্র ভোল্টের_ তবে তো নিজেকে আরো সচেতন ভাবে প্রস্তুত করতে হয় সেই 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন শুনার জন্য।
বইয়ের ফাপ ও বিভিন্ন লিটলম্যাগ দেখে জানা যায় 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর কবি, জফির সেতু ছোট কাগজ চর্চার সাথেও জড়িত। তাছাড়া ফাপের প্রথম অংশে লিখিত বেনামী প্রাককথণে যখন দেখি...' _ যা অবশ্যই রাহমানের চিড়িয়াখানা-র চাইতে পৃথক, মাহমুদের আসঙ্গলিপ্সার থেকে দূরবর্তী, _গর্জমান এবং আলো-বিচ্ছুরণশীল যে চোখ ঝলসে দিতে সম...' তখন চোখের হিসেব ছেড়ে দিয়ে কানকে বলি_ তুমি প্রস্তুত হও গর্জন শুনার জন্য, মস্তিস্ক প্রস্তুত হও ধারণের জন্য আর হৃদয় তৈরী থেকো অনুভবের জন্য। তবে এবার কবি জফির সেতু 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন কতটা সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন সাদা কাগজের প্রতিটি পৃষ্ঠায়; তা আবিস্কারের জন্য পাঠ শুরু করা যাক।
যেহেতু এই কবির স্বর রাহমান কিংবা মাহমুদের মত নয়, (হবে-ই-বা কেন?) তাই একজন কবি'র কবিতা চলমান দশকেই পঠিত হচ্ছে বলে পাঠকের অতিরিক্ত মনোযোগ দাবী করতেই পারে।

"সিন্ধুর গোপন গান জীবনে খুব কম লোকে শোনে
আমাকে প্রতিভু পাখি ভেবে যারা বসিয়ে রাখে পাতায়
তাদের নাড়িতে টাইগ্রিস লোহিত উত্তেজনায় কাঁপে"
'এমন বসন্তদিনে'


তাই সঙ্গত কারণেই ছাবি্বশটি গর্জনে কেমন করে ফঁটে উঠেছে 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর চরিত্র_ তা দেখার দাবী রাখে।

"টাওয়ার থেকে যে ফড়িংটি নেমে এল
তার জন্য দরকার আরেকটি ইকোপার্ক
পৃথিবীর পথে পথে ইলেকট্রিক সিগন্যাল
এই ভেবে আমরা যখন পা থেকে কাদা ঝাড়ছি
নারীরা কী ভেবে যে ঘুম ঘুম চোখে কাঁদছে, শুধু কাঁদছে"
'ফড়িং'

আমার কাছে মাঝে-মধ্যে মনে হয়, একটি লাইন-ই বুঝি কবিতার প্রাণ কিংবা সমগ্র কবিতাই বুঝি একটা লাইন। যেখানে অনুভূতির গভীরে সহস্র লাইনের বিচ্ছুরণ ঘটে। আর এমন একটি প্রসঙ্গের আলোচনায় আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছিলেন, 'আসলে সবাই মিলে আমরা একটা কবিতা-ই তো লিখে চলেছি। এ যেন সহস্র নদীর একটি ঢেউ-এর মত।' তাঁর-ই এক লাইনের একটা কবিতা আছে এমন_ 'নষ্ট চোখে পাখিকেও পৃথিবীর ময়লা মনে হয়।' তেমনি জফির সেতু'র কবিতায়ও কিছু প্রাণসঞ্চারী পংক্তি আছে। পাঠকের জন্য উল্লেখ্য করছি_
ক. 'এখন তাদের এঁদো দালানে দুপুর রাতে পথ হারায় অন্ধ জোনাকি' [প্রত্যহ প্রবাহ]
খ. 'রাষ্ট্র বিপ্লবে কামার্ত রমণীরা কখনো বীরপ্রসূ হতে পারে না' [জীবন বৃত্তন্ত]
গ. 'মধুর চাকের অন্ধকার আমাকে জাগিয়ে রাখে' [আত্নজৈবনিক]
ঘ. 'কত লোভ আর ঝড়ো অন্ধকার মৃত্তিকার পাহাড়ে' [স্তন]
ঙ. 'পাতার আড়ালে পড়ে আছি অহেতুক পতঙ্গের মতো বহুকাল' [অহেতুক পতঙ্গ]

তবে কবিতার বিচারে কোন মন্তব্যই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের প্রেেিত এর আবেদন বদলাতে পারে এবং বদলায়। 'আমরা জানি সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার সংজ্ঞার্থের যেমন চরিত্র বদল ঘটেছে, তেমনি এককালের আধুনিকেরা সময়ের নির্মম বিচারে প্রথাগত অবিধায় বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু একটা জাতিস্বত্তার মিথ, প্রত্নস্মৃতি, নৃবৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম, ঐতিহ্যবোধ, প্রেম-অপ্রেম, মন ও মনন যখন কোন কবির আধার ও আাধেয়কে সম্পন্নতা দান করে_ তখন প্রথাচিহ্নিত বর্জনের তালিকায় তাকে নিপে করা যায় না।' [ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের তিন দশকের কবিতা: রফিক উল্লাহ খান]
কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কবিকে চিহ্নিত করতে হয় তাঁর স্বাতন্ত্র বা রহঃড়হধঃরড়হ দিয়ে। পূর্ববতর্ী থেকে নিজেকে আলাদা হিসেবে ঘোষণা দিলে তার জন্য প্রয়োজন পড়ে কিছূ আলাদা বৈশিষ্ট্যের।

শিশুর কড়ে আঙুলে গাঢ় টৌকা মারি ফড়িঙের ডানায় একটা হেলিকপ্টার বাঁধি' (ছায়া)

উক্ত কবিতাটিতে যে 'সহস্র ভোল্টের বাঘ' এর গর্জন মুদ্রিত হয়েছে তা আবিস্কারের পর কবি'র অভিলাষের প্রসংশা না করে পারা যায় না। এই পংক্তিতেই সহস্র ভোল্পের বাঘ এর সত্যিকারের গর্জন প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়।
কিন্তু 'প্রেম' কবিতায় যখন একই কবি আবার লিখেন_

'প্রেম, মাঝরাতে সঙ্গমরত টিকটিকি ধপাস করে বুকের উপর পড়ে যায়
দুপুরে অফিস ফাঁকি দিয়ে ছুটা বুয়ার সাথে ধস্তাধস্তি করে
প্রেম, তাগড়া ষাড়ের মতো মাটিতে হুংকার দিয়ে তেড়ে তেড়ে আসে
আমি কখনো এদের সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারি না!

তখন ভাবি, নীতি-নৈতিকতার ভয়ে যে কবি 'প্রেম' এর মত 'ট্রাডিশনাল ইমোশন' এর মুখোমুখি হতে ভয় পান তিনি নিজের