ইসলামী দেশ এবং এর রীতিনীতির মধ্যে যা আসে তার মধ্যে পর্দাপ্রথা বা হিজাব অন্যতম। আমাদের দেশ সাংবিধানিক ভাবে ধর্মীয় হলেও গণতান্ত্রিক শাষণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও কোরান ও সুন্নাহ’র শাসন ব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই নাগরিকরা কিছুটা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন এবং বিধর্মীরা একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন। কিন্তু কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক শাষণ ব্যবস্থা চালুর জন্য মরিয়া কিছু উগ্র ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং এর অংগ সংগঠনগুলো ইসলামী বিভিন্ন কট্টরপন্থি নিয়মনীতি চালু করে দিয়েছে। তার মধ্যে ‘হিজাব’ উল্লেখ্যযোগ্য।
স্বাভাবিকভাবে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নারী। কেনোনা তারা জানে একটি নারীকে বন্দী করতে পারলে পরিবারকে বন্দি করা সম্ভব। তাছাড়া, নারী জাতি সহনশীল এবং তুলনামুলকভাবে কম প্রতিবাদী হওয়ায় তাদেরকেই লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছে উগ্র ইসলামী গুষ্ঠিগুলো। আর এর প্রভাব পড়েছি বাংলাদেশের সর্বত্র। একটি দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠে যখন ছাত্রীদের বাদ্য করা হয় বোরকা পড়তে, তখন অবাক না হয়ে পারি না! কিন্তু একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এই আরোপিত ‘হিজাব’ কে সমর্থ করতে পারি না। আর আমি তাই চাইও না আমার কেউ বোরকা পড়ুক। তাহলে ব্যাখ্যা করেই বলি, “আমি কেনো চাই না আমার বান্ধবী বোরকা পড়ুক”।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জনের মত মুসলিম। স্বাভাবিক ভাবে জন্মগতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হচ্ছে ইসলাম। নারী পুরুষের সংমিশ্রণে এই দেশ। আর নারী ও ইসলাম নিয়ে কথা উঠলেই কথা আসে পর্দাপ্রথার অর্থাৎ হিজাবের। ইসলামে নারী ও পুরুষ সবাইকে পোষাকের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া আছে। কিন্তু কাজ ভেদে, খেলাধূলার ধরন ভেদে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে, ভৌগলিক অবস্থান ও অঞ্চল ভেদে, কখনো বা সময়ের প্রভাবে পোষাক যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাল্টায়। যাতে ঐ বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ তার ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু ইসলামে নারীর পোষাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ পোষাকের এই যৌক্তিক কার্যকারণগুলোকে মানে না। তাই এত বিতর্ক। অন্যান্য অনেক ধর্মেও নারীর পোষাক সম্পর্কে একরকম চাপিয়ে দেয়া আইন-কানুন আছে (মাদার তেরেসা বা তার অনুসারীদের পোষাক; মাথায় কাপড় ও লম্বা হাতার বস্নাউস দেখলে তাদেরকে মুসলিম পর্দানশীন মহিলাই মনে হয়)। সেসব ধর্মের নারীরা প্রতিবাদ করে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের জন্য স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মুসলিম নারীসমাজ সেই অবস্থা এখনও অর্জন করতে পারেননি।
আসুন দেখি হিজাব শব্দটি কোথা থেকে এসেছে। শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ হাজাবা থেকে, যার অর্থ লুকানো। কোরানে হিজাব ছাড়াও 'জিলবাব' ও 'খিবার' এর কথাও আছে। কিন্তু ধর্মানুসরণ করে মুসলিম রমণীরা বিভিন্ন দেশে আরো বিভিন্ন রকমের পোষাক পরেন যা ধর্মের চেয়েও মূলতঃ তাদের সাংস্কৃতিক বা অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যের বিষয়টিই তুলে ধরে। এ ধরনের পোষাক ও তার ছবি প্রায়শই বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় যে ছবিগুলো দেখলে নারীদের এক ধরনের কয়েদি বা অন্যগ্রহের কোনো আজব প্রাণি বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, জেলখানার কয়েদিদের যেমন পরিচিতির সুবিধার্থে এক ধরনের পোষাক পড়তে বাধ্য করা হয় এসব নারীরাও সামাজিক ও ধর্মীয় নীতি-নির্দেশের কারণে একধরনের বিশেষ পোষাক পরতে বাধ্য। শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ এবং যুগ যুগ ধরে আবদ্ধ থাকার ফলে এখন অভ্যস্থ। আর এই হিজাবের রয়েছে ধেশ অনুযায়ী বিভিন্ন নাম এবং ধরণ। বিভিন্ন মুসলিম জন-প্রধান দেশে যেসব পোষাক পাওয়া যায় তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হলো।
• মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় দেখা যায়: হায়েক, সাফসারি, আখনিফ এবং আজার।
• মিশর, ইজরায়েল, সিরিয়া, ইরাক ও বেদুইনদের মধ্যে দেখা যায়: আবায়া, তারনা, ইজার, মিলহাফা, খাবারা, চাম্বার, নিকাব, লিথাম, ও বোরকো।
• ইরানে দেখা যায়: বোরদা, চাদর, পিচা এবং রৌবন্ধ।
• তুরস্কে দেখা যায়: ইয়াচমেক, ইয়ালেক, হারমানিয়া, ও এনতারি।
• বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপে দেখা যায়: বোরকা।
মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে এই পর্দাপ্রথা হয়ে উঠেছে প্রধান অন্তরায়। দাসত্বের এই প্রতীকের জন্য তারা ক্ষমাগত নিম্নমুখি হচ্ছে। পুরুষ আধিপত্যের শেকল ছিঁড়ে নিজ গৃহের বন্দিত্ব থেকেই মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে নারীরা এর বিরোধীতা করে নি তা নয়। মুসলিম রমণীরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এসব প্রথার বিরুদ্ধে।
১৯২৩ সালে মিশরে প্রথম একটি প্রতিবাদ হয়, মিশরের ফেমিনিস্ট ইউনিয়নের প্রধান মিজ হুদার নেতৃত্বে। তিনি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে তাদের পর্দা ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। তুরস্কে হিজাবের বিরুদ্ধে সরকার থেকে লড়াই শুরু হয় ১৯২৭ সালে। তখন কম্যুনিস্ট সরকার ছিল ক্ষমতায়। সেই সময় ৭,০০০ মহিলা প্রকাশ্যে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের সাথে শত্রুতা করার জন্য তাদের ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজকের যে কট্টর আফগানিস্তান সেখানেও বাদশা শাহ এর সময় স্বাধীনতা উৎসবে, ১৯২৮ সালে পর্দাপ্রথার শেকল থেকে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে জনসম্মুখে পর্দা ছাড়া উপস্থিত হতে বলেছিলেন। পরে মুসলিম মৌলবাদীর ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে নারী মুক্তির সব ধরনের প্রকল্প তাকে বাদ দিতে হয়েছিল। ক্ষমতাও ছাড়তে হয় তাকে। ইরানের রেজা শাহ ১৯৩৬ সালে একটি বিশেষ আইন করে 'চাদর' পরা বন্ধের আদেশ দেন। কিন্তু সংস্কৃতির বিপক্ষে তার এই আদেশ জনপ্রিয়তা পায়নি এবং জনপ্রতিবাদের মুখে ১৯৪৬ সালে তিনি আবার তা পুনর্বহাল করেন।
আজকে যেমন বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন স্থানে ‘হিজাব’ নিয়ে বিতর্ক চলছে, তেমনি ইসলামে হিজাবের উৎপত্তির কারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
তবে কোরানে এ সংক্রান্ত আয়াত গুলোর (৩৩.৫৩, ৩৩.৫৯, ৩৩.৩২-৩৩) মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নীচের আয়াতটি (২৪:৩১)
“And say to the believing women that they should lower their gaze and guard their modesty; that they should not display their beauty and ornaments except what (must ordinarily) appear thereof; that they should draw their veils over their bosoms and not display their beauty except to their husbands, their fathers, their husband's fathers, their sons, their husbands' sons, their brothers or their brothers' sons, or their sisters' sons, or their women, or the slaves whom their right hands possess, or male servants free of physical needs, or small children who have no sense of the shame of sex; and that they should not strike their feet in order to draw attention to their hidden ornaments. And O ye Believers! Turn ye all together towards Allah, that ye may attain Bliss.”
হিজাব, পর্দা ইত্যাদির চল এবং মুসলিম রমণীরা বাড়িতে থাকবেন এ ধরনের প্রথা ইসলামের মাধ্যমেই মক্কা-মদিনায় চালু হয়। কিন্তু সমসাময়িক বেদুইন মহিলারা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তারা তাদের স্বামীর সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং নতুন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে জীবন ধারনের কাজে একত্রে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু অন্যান্য সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাবে ইসলামেও বিভিন্ন পর্দা-প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে। হিজাব বা পর্দাপ্রথাটির বিষয়টি আরবরা গ্রহণ করে পারসিদের কাছ থেকে। মহিলাদের ঘরে থাকার আদেশটি আসে বাইজাইন্টাইন ঐতিহ্যের অনুকরণে, যারা মূলতঃ এটি পেয়েছিল একটি প্রাচীন গ্রিক প্রথা থেকে।
পর্দা নারীর মুক্ত বিচরণকে রুদ্ধ করে দেয় এটি বলার অবকাশ রাখে না। যদিও মুসলিম রমণীদের অনেকে তাদের প্রয়োজনমত এসব নিয়মকানুনকে একটু মোচড়ে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব একটা সরব প্রতিবাদে তারা সহজে জড়াতে চান না সাধারণত পরিবার সমাজ ধর্ম এবং রাষ্ঠ্র আরোপিত শাস্তির বয়ে। কিন্তু ‘হিজাবের’ অর্থ কেবল পোষাকের মাঝে জড়িত মনে করলে ভুল করা হবে। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরো অনেক নিয়ম-নীতি। যদি প্রশ্ন উঠে যে মুসলিম নারীর কি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে? এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে তার নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাও হিজাবের বা পর্দা প্রথার অংশ।
এ বিষয়ে কোরানের সংশিস্নষ্ট আয়াত হচ্ছে ৩৩.৩৩:
“And stay quietly in your houses, and make not a dazzling display, like that of the former Times of Ignorance; and establish regular Prayer, and give regular Charity; and obey Allah and His Messenger. And Allah only wishes to remove all abomination from you, ye members of the Family, and to make you pure and spotless.”
এই যে ঘরের মধ্যে নীরবে থাকার নির্দেশ; তা কোরানের। যারা ইসলামের সংশোধনে বিশ্বাসী এবং নিজেকে বিতর্কের বাহিরে রাখতে চান তারা এর সাথে আগের আয়াত যুক্ত করে একে চিহ্নিত করেন শুধুমাত্র নবীর স্ত্রীদের জন্য আদেশ বলে। যদিও নবীর কাজ এবং সম্মতি হাদিসের আওতায় পড়ে। যারা গোঁড়া/উগ্র মৌলবাদী কিংবা ইসলামী শাসন কায়েমে বিশ্বাসী তাদের মতে এই আদেশ সকল মুসলিম রমণীদের জন্য। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হয় নানা কারণেই। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমাগত প্রচারনার মাঝে মুসলিম ধর্ম-বেত্তাদের পক্ষে নারীকে আর শুধু ঘরে আটকে রাখার বিধান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না (বিশেষত: শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে)। তবে, ইসলামী মতেও একজন নারী ঘরের বাহিরে যেতে পারেন। আসুন দেখি কিভাবে একজন নারী ঘর থেকে বের হতে পারে তার নমুনা:
(কোরান ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন মুসলিম মনীষিরা এই নীচের তালিকাটি ব্যবহার করেন)
• ১. শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মুসলিম নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশেষ প্রয়োজনটা কি? কোন অবস্থায় একজন নারী ঘর থেকে বের হতে পারবেন তা নির্দিষ্ঠ নয়। আমরা যদি মনে করি একজন নারীর প্রচন্ড মাথা ব্যথা এবং তার ঔষধ প্রয়োজন, তখন তিনি কি করবেন? অথবা রান্নার সময় ঘরে লবণ নেই, তাও কি বিশেষ প্রয়োজনের আওতায় পড়ে?
• ২. তার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার স্বামী বা আইনসঙ্গত অভিভাবকের অনুমতি থাকতে হবে।
নারীর ঘরের বাহিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপরের নিয়মের সাথে এই নিয়মটি সাংঘর্ষিক। কেননা, যদি বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যেতে পারে, তাহলে আইনসঙ্গত অভিবাবকের অনুমতির দরকার কি? আর যদি অনুমতি অবশ্যই দরকার হয় তাহলে বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যাবে কি করে? এখানে আরো প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন, একজন অবিবাহিত মেয়ে তার পিরিয়ড চলাকালে যদি স্যানিটারি নেপকিন কিনতে বাহিরে যায় এবং তার বাবার কাছে অনুমতি চায় আর তখন যদি তার বাবা কারণ জানতে চান (অবশ্যই কারণ বলতে হবে)তখন সে কি বলবে?
• ৩. তাকে মুখ সহ পুরো শরীর ভালোভাবে ঢাকতে হবে, যাতে আশে-পাশের কোনো পুরুষকে তার রূপ লালসাগ্রস্থ না করতে পারে এবং সে অবশ্যই তার মাথা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে সোজা হেটে যাবে। (কোরান: ২৪:৩১)
প্রথমত আমরা যদি চিন্তা করি একজন মানুষ সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে, তাহলে শুনতে কেমন লাগবে? আসলে এখানে এই ‘কেমন লাগবে’ ভাবার আগে ভাবতে হবে কোরানে উক্ত কথাগুলো অনুদিত হওয়ার আগে নারীকে ‘মানুষ’ ভাবা হয়েছে কি না? পুরুষকে তার রূপ লালসাগ্রস্থ করতে পারে বলতে নারীকে সরাসরি ভোগ্যপন্য হিসেবে স্বয়ং কোরানেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভোগ্যপন্যের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে তা তো অনুমান করাই যায়।
• ৪. পুরুষদের সাথে পথের মাঝ দিয়ে সে হাঁটতে পারবে না। মসজিদ থেকে কিভাবে বের হতে হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে ইসলামের নবী আদেশ দিয়েছেন: "নারীদের পুরুষের মাঝে হাঁটার কোনো অনুমতি নেই; তোমাদের উচিত রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটা।"
“নারীদের পুরুষের মাঝে হাঁটার কোনো অনুমতি নেই; তোমাদের উচিত রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটা।” যারা এখন মাঝে মাঝে দাবী তুলেন, ইসলাম নারীকে অনেক আগেই সম-অধিকার দেয়া হয়েছে এই একটি উদ্ধৃতি তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যতেষ্ঠ। পুরুষের পাশাপাশি নারীকে কতটা সম্মান আর অধিকার দেয়া হয়েছে তা এই হাদিস থেকেই বুঝা যায়। যেখানে পর্দা বা ‘হিজাব’ করার পরও নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা রাখা হচ্ছে।
• ৫. হাঁটার সময় পা মাটিতে ফেলে শরীরের গোপন অলংকারের শব্দ করা যাবে না কারণ এতে পুরুষ আকর্ষিত হতে পারে। (ফলে হাইহিল বা পায়েল জাতীয় অলংকার পরা নাজায়েজ।)
পুরুষ আর্কষিত হতে পারে এজন্য নারীকে কিভাবে সচেতন থাকতে হবে তা বলা হচ্ছে! কতটুকু হাস্যকর হতে পারে যুক্তিটা দেখলেই বুঝা যায়। যেমন ধরুন আপনার একটা বাড়ি আছে, সেই বাড়িটা দেখলে চোরের চুরি করার ইচ্ছে হতে পারে, তাই বলে কি আপনি বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলবেন অথবা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখবেন? চোর যেনো চুরি না করে সেই পরিবেশ তৈরি না করে উল্টোটা করা হচ্ছে!
• ৬. মহিলারা অবশ্যই গায়ে কোনো সুগন্ধী ব্যবহার করবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, “যে মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে এবং পুরুষদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সে অসতী”।
“যে মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে এবং পুরুষদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সে অসতী” অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। পুরুষ ইচ্ছে করলেই তা করতে পারবে এবং সে অসত হবে না। ইসলাম নারীকে শুধু পর্দা দিয়ে আটকে রাখতে চায় নি বরং যাবতীয় সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে আলাদা ভোগ্যপন্য করে রাখতে চেয়েছে।
• ৭. অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠ স্বাভাবিক থাকতে হবে। (আয়াত ৩৩.৩২)
এখানে কিন্তু অপরিচিত বলতে পরপুরুষ বা বাহিরের কাউকে বোঝানো হয় নি। বোঝানো হয়েছে রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কাউকে। অর্থাত মামা, খালু, দেবর এদেরকে। আর কণ্ঠ স্বাভাবিক বলতে স্পষ্টত আমরা বুঝি কামভাব না থাকা। নারীকে আবদ্ধ রাখার কতটুকু পরিকল্পনা থাকলে এমন শর্ত দেয়া যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!
• ৮. কোনো অফিস বা দোকানের ভেতরে কোনো মহিলাকে একজন পুরুষের সাথে একাকী রাখা যাবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, "একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে কখনই এমন কথাবার্তা হয় না যার মধ্যে শয়তান কু-কাজ না করে"।
মূলত নারীকে যাবতীয় সেক্স থেকে দূরে রাখার জন্যই এই পর্দাপথা তথা ‘হিজাব’। হিজাবের অর্ন্তনিহীত তাৎপর্য হচ্ছে কিভাবে নারীকে ‘কাম’ থেকে বিরত রাখা যায় তাই খুঁজে বের করা। একজন পুরুষ আর একজন নারী একত্রিত হলেই শযতানের কুমন্ত্রনায় তারা যৌন কাজে লিপ্ত হবে এমনটি ভাবার জন্য কত নিচু মানুষিকতার হতে হয় তা এই একবিংশ শতাব্দিতেও ভাবা যায় না।
• ৯. একজন নারী কখনও পুরষের সাথে হ্যান্ডশেক করতে পারবে না।
যেখানে নারীকে পুরুষের কাছাকাছিই আসার অধিকার দেয়া হচ্ছে না, সেখানে একজন নারী কি করে হ্যান্ডশেক করবে?
• ১০. এমনকি অন্যকোনো নারী বান্ধবীর বাড়িতেও সে তার পর্দা বা হিজাব খুলতে পারবে না কারণ সে ঘরের মধ্যে কোনো পুরুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। ইসলামের নবী বলেছেন, "যদি কোনো নারী তার নিজের বাড়ি বা তার স্বামীর বাড়ি ভিন্ন অন্য কোথাও তার পর্দা সরিয়ে ফেলে তবে সে সেই পর্দাটি সরিয়ে ফেললো যা তাকে খোদার সামনে নিজেকে রক্ষা করতো"।
একজন নারী অন্য একজন নারীর সামনেও পর্দা করতে হবে তাও লুকিয়ে থাকা পুরুষের ভয়ে? নারীর প্রতি কতটা নির্দয় হলে এমন আদেশ আসতে পারে বুঝায় যাচ্ছে।
• ১১. স্বামী বা যথোপযুক্ত আত্মীয়-সঙ্গী ছাড়া একজন স্ত্রী ত্রিশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব যেতে পারবে না।
নারীর দূরত্ব ও বেধে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ যে, আমাদের দেশে যখন কোনো নারী বাহিরে যায় তখন তার নিরাপত্তার জন্য ছোট বাচ্ছাদের দেয়া হয় যে নিজেই কিনা নিরাপত্তা কি বুঝে না। এই প্রথা দেখলে বুঝা যায় ইসলাম ধর্ম নারীকে কতটা দূর্বল ও অবিশ্বাস করে।
• ১২. একজন নারীর কখনও কোনো পুরুষকে অনুকরণ করা উচিত নয়।
নবী রা তো মহান। সবাই তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু নারীরা কি নবীদের অনুসরণ করতে পারবে? আর পারলে প্রশ্ন জাগে নবীরাও তো পুরুষ!
এই হল একজন নারীর ঘর থেকে বের হওয়ার নিয়ম। এখানেই শেষ নয়। আবার এই নিয়মেরও রয়েছে বিভিন্ন শর্ত। যা কোরান ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। চলুন সংক্ষেপে সেই শর্তসমূহগুলো দেখিঃ
• সমস্ত শরীর ঢাকা
• কারুকার্য ও নকশা বিহীন পর্দা ব্যবহার করা
• পর্দা সুগন্ধি বিহীন হওয়া
• শীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেসে উঠে এমন পাতলা ও সংকীর্ণ পর্দা না হওয়া
• পর্দা শরীরের রং প্রকাশ করে দেয় এমন পাতলা না হওয়া
• নারীর পর্দা পুরুষের পোশাকের ন্যায় না হওয়া
• সুখ্যাতির জন্য পরিধান করা হয় বা মানুষ যার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, পর্দা এমন কাপড়ের না হওয়া
• পর্দা বিজাতীয়দের পোশাক সাদৃশ্য না হওয়া
বুঝাই যাচ্ছে যখন এই নিয়ম-নীতি প্রণিত হয়েছিল তখন সেখানে কোনো নারীর অংশগ্রহণ দূরে থাকুক, তাকে পুরুষের মত মানুষ হিসেবেও কল্পনা করা হয় নি। যতদিক থেকে, যতভাবে নারীকে আবদ্ধ এবং শৃঙ্খল রাখা যায় তারই প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে শুধু নারীকে পোষাকের অভ্যন্তরে রাখার জন্য! অন্যদিক এবং অন্যান্য বাধা-নিষেধ তো রয়েছেই। আজকের আধুনিক সমাজে যখন দেখি কোনো সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধ্যান-ধারণা এবং চেতনা দিয়ে নারীকে পর্দা বা হিজাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখার দলগত এবং ব্যক্তিগত চেষ্ঠায় লিপ্ত তখন অবাক এবং প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠ তথা বিশ্ববিদ্যারয়ে যখন কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দলের অঙ্গ-সংগঠন ভয়-ভীতি এবং জোড় পূর্বক নারীকে বোরকায় আবদ্ধ করতে চায়, তখন আমাদের বিবেক থমকে যায়। এই একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের বাংলাদেশে চলছে নারীকে হিজাবের আবরণে আবদ্ধ করার প্রচেষ্ঠা। সময় এসেছে নিজেকে, নিজের সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস এর মোহ থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তি এবং বাস্তবতার আলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার।
আমি আমার বান্ধবীকে একজন মানুষ মনে করি। সে আমারই মত রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ। যে এই সমাজের আর সবার মত এবং যার রয়েছে সমাজের প্রতি মমতা। যে আমারই মত কখনো বা আমি তার মত করে স্বপ্ন দেখি। আর আমি যেমন আমাকে কখনো পরাধীন ভাবতে পারি না, কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানতে পারি না তেমনি আমার প্রিয়জনকে, আমার বান্ধবীকেও ভাবতে পারি না। ‘হিজাব’ বা পর্দাপ্রথা আমার কাছে দাসত্বের প্রতীক, অবরোধের হাতিয়ার। আর সঙ্গত কারণেই আমি চাইবো না আমার প্রিয়জন কিংবা আমার বান্ধবী শৃঙ্খলিত থাকুক, অবরোদ্ধ থাকুক। তাই আমি চাই না আমার বান্ধবী বোরকা পড়ুক।
এর দ্বারা পোস্ট করা
suMon azaD (সুমন আজাদ)
লেবেলসমূহ:
মুক্ত সংলাপ