আড়াই-তিন বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে একা একা খেলছে। উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে আর নিজ মনে কথা বলছে। পাশের বাসার দেওয়ারের ফাঁক দিয়ে হামিদা বেগম শিশুটিকে দেখছিলেন। তিনি শিশুটির চঞ্চলতায় মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। খেলতে খেলতে হঠাৎ শিশুটিরও নজর পড়ল হামিদা বেগমের উপড়। সে একটু লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসল। হামিদা বেগমও মিষ্টি করে হাসলেন। হেসে হেসেই জিজ্ঞেস করলেন,
- কি করছো তুমি?
শিশুটি তার হাতের ভাঙ্গা গাছের ডালটা দুলিয়ে দুলিয়ে হামিদা বেগমের আরো কাছাকাছি এগিয়ে এলো। কিন্তু কিছু বলল না। হামিদা বেগমের দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে থাকলো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- তুমি একা একা খেলছো বুঝি?
শিশুটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল।
- তোমার কি নাম? শিশুটি বেশ ¯^vfvweK হয়ে বলল,
- বাবা। আমার নাম বাবা। আমাকে তবাই বাবা নামে দাকে? হামিদা বেগম হেসে হেসে বললেন,
- তাই! তোমাকে সবাই বাবা ডাকে?
- হু। আমার কাকু বাবা দাকে, আব্বু বাবা দাকে, মামনি বাবা দাকে, আমার কুয়েল বাবা দাকে, আমার তাগলও আমাকে বাবা দাকে! হামিদা বেগম আবারো হাসলেন। হেসে হেসেই বললেন,
- তোমাকে ছাগলও বাবা ডাকে? শিশুটি আরো আগ্রহী হয়ে বলল,
- তবাই আমাকে বাবা দাকে। আমি তবার বাবা। হামিদা বেগম বললেন,
- আচ্ছা সবার বাবা, তুমি একা একা কি খেলছিলে?
- কেলতিলাম না তো। আমি আমার কুয়েলের তাথে কতা বলতিলাম। তুমি আমার কুয়েল দ্যাকবে? আমার দুই-তা কুয়েল আছে। দাঁলাও তোমাকে দেকাই, বলেই দৌঁড়ে কুয়েল আনতে চলে গেল। হামিদা বেগম বাউণ্ডারীর এপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।
উনারা এই বাসা ভাড়া নিয়ে উঠেছেন সপ্তাখানেক হল। ¯^vgx একটি বেসরকারী সংস্থা থেকে অবসর নেয়ার পর নিজেদের এলাকার gd¯^j শহরের এই বাসায় উঠেছেন। হামিদা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা বড়। বিয়ে হয়ে গেছে। ¯^vgxi বাড়িতে থাকে। তার বড় ছেলেটা বিয়ে করে চাকুরী সূত্রে বউ নিয়ে অন্য শহরে থাকে। ছোট ছেলে লেখা পড়া করে রাজধাণী শহরে। বাসায় হামিদা বেগম আর উনার ¯^vgxB থাকেন। তার ¯^vgx সারা জীবন চাকুরী করে সন্তানদের লেখাপড়া করানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেন নি। উনি আবার বই পাগল মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় উনার পাঠাগারে। বাড়িতে একাই থাকেন হামিদা বেগম। উনার বাসার পাশের বাসা হচ্ছে এই ছেলেটির। ওদের বাসার চারপাশেই দেয়াল দেয়া। শুধু হামিদা বেগমদের বাড়িওয়ালার কিছু অংশ বাঁশের বেড়া দেয়া। আর এই ফাঁক দিয়েই কথা বলছিলেন।
শিশুটি একটা খাঁচা নিয়ে বেড়ার ওপাশে এসে দাঁড়াল। হামিদা বেগমকে দেখিয়ে বলল,
- এই দ্যাকো আমার কুয়েল পাকি। তিনি পাখিগুলো দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,
- এটা তো ঘুঘু পাখি, কুয়েল বলছ কেন? সে প্রতিবাদ করে বলল,
- না, না, এতা আমার কুয়েল পাকি। তুমি তেন না। তারপর কুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল,
- এই কুয়েল, বাবা বল। বল না, বল, বাবা বল। পাখিগুলো কোন শব্দ না করায় সে হামিদা বেগমের দিকে একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিচু ¯^‡i বলল, - তোমাকে দেকে কতা বলছে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, অন্য দিন শুনবো। হামিদা বেগম এই কথা বলে হেসে সুন্দরভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা কুয়েলের বাবা, তোমাকে তো বাসার সবাই বাবা বলে ডাকে, কিন্তু বাহিরের মানুষ কি বলে ডাকে? সে ঝটপট উত্তর দিল
- আমা-দেল পেপারমামা (পেপারওয়ালা) পাপন তোনা বলে দাকে।
- আচ্ছা পাপন সোনা, তুমি একটু দাঁড়াও। আমি চুলায় তরকারী বসিয়েছি তো, সেটা দেখে আসি।
- আত্তা। পাপন সম্মতি দিল। হামিদা বেগম তার কাছ থেকে চলে এলেন। পাপন সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। বাসার ভেতর থেকে তার মা ডাকলে সে-ও চলে যায়। পাপনদের বিরাট বাড়ি। বাড়ির মেইন গেট সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। সম্ভবত পাপন বেড়িয়ে যেতে পারে এই জন্য। তাই পাপন ওদের ছোট্ট আঙিনায় হেঁটে বেড়ায়। তার বয়েসি আর কোন বাচ্চা এ-বাড়িতে নেই যার সাথে সে খেলা করবে। কিংবা কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা মানুষকেও দেখা যায় না পাপনের খবরদারী করতে। তাই সে একা একাই তার কুয়েল, ছাগলের বাচ্চা আর উঠোনের ছোট্ট বাগানের গাছগুলোকে নিয়ে একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে
তুলেছে। এখন অবশ্য তার জগতে আরেকজন যুক্ত হলেন। হামিদা বেগম। পাপন এদিকে এলেই বাঁশের বেড়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। হামিদা বেগমও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে দাঁড়ান। দুজনের মধ্যে কত কিছু নিয়ে কথা হয়। তিনি তন্ময় হয়ে পাপনের কথা শুনেন। তার কথা মুখে আটকে যাওয়ার ফলে যে নতুন নতুন শব্দ তৈরী হয়, তার অর্থ উদ্ধার করতে পেরে তিনি যেন কিশোরীদের মত হেসে কুটিকুটি হন। পাপনও মনের সুখে কথা বলে যায়। একদিন পাপন হামিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করল,
- তোমলা কোন বাতায় তাক? আমাদের চাদে উতলে তোমা-দেল বাতা দ্যাকা যায়? হামিদা বেগম বললেন,
- এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার পিছনের বাসাটাই আমাদের। পাপন বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে বলল,
- ও।
- তুমি আসবে আমাদের বাসায়? এ কথা শুনে পাপন খুবই খুশি হল। খুশিতে তার চোখগুলো জ্বল জ্বল করে উঠল। তার পরই হঠাৎ মুখ করুণ করে বলল,
- কি কলে আতবো?
হামিদা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আসলেই তো! কি করে পাপন আসবে? এত বড় দেওয়াল তার পক্ষে পেরুনো সম্ভব নয়। তাকে আসতে হবে মেইন গেট দিয়ে বেড় হয়ে সদর রাস্তা ঘুরে। কারণ এদের বাসার গেট হামিদা বেগমদের বাসার গেটের বিপরীতে। পাপনও কোন কথা বলছিল না। হামিদা বেগম নীরবতা ভেঙ্গে পাপনকে বললেন,
- পাপনসোনা, তুমি সত্যি সত্যি আমাদের বাসায় আসতে চাও?
পাপন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
- তাহলে তোমার আম্মুকে বল ছাদে উঠার জন্য। আমিও আমাদের ছাদের উপড় উঠব। দু-বাসার ছাদ একেবারে কাছাকাছি আছে। আমি তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে আসবো।
- তুমি আমাকে কোলে তুলে নেবে! তাহলে আমি আম্মুকে বলি। পাপন দৌঁড়ে বাসার ভেতর চলে গেল। হামিদা বেগম নিজেদের দু’তলা বাসার ছাদে উঠলেন। দু-বাসার ছাদই বিশাল। হামিদা বেগমদের বাড়িওয়ালার বিশাল ছাদে তিনি পাপনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কিন্তু সে এলো না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তিনি ভাবলেন, পাপনের মা হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। তাই আর নিয়ে আসেন নি। তিনি যে কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন তেমন ব্যবস্থাও নেই। তাছাড়া কখনো ও-বাসার কারো সাথে তিনি কথা বলেন নি। পাপন ছাড়া আর কাউকে চেনেনও না। ভেবেছিলেন আজ পরিচিত হবেন, কিন্তু পাপনকে নিয়ে কেউ এলো না।
পরদিন হামিদা বেগম বাঁশের বেড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু পাপনের দেখা পেলেন না। কাউকে পাপনের কথা জিজ্ঞেস করবেন তেমন কাউকে পেলেনও না। হামিদা বেগম দেখলেন পাপনদের বিশাল বাড়িতে লোক সংখ্যা একেবারেই কম। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল। তিনি আসেন কিন্তু পাপন আর আসে না। একদিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, দেখলেন পাপন তাদের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছে। তিনি হাত ঈশারায় পাপনকে ডাকলেন। পাপন হামিদা বেগমকে দেখে অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ আম্মু আম্মু বলে কেঁদে দৌঁড়ে বাসার ভেতর চলে গেল। পাপনের ভয় পাওয়া চোখ দেখে হামিদা বেগম প্রথমে অবাক হলেন। কিছুই বুঝতে পারলেন না। ভাবলেন, কি ব্যাপার ছেলেটা তাকে দেখে এত ভয় পেল কেন। তারপর হামিদা বেগমের একটু একটু করে মনে পড়ল, ছোটবেলা মা তাকে প্রায়ই সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, অপরিচিত মানুষ ডাকলে কাছে যেয়ো না। এরা ছেলেধরা। তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। সেই থেকে কোনো অপরিচিত মানুষ দেখলেই হামিদা বেগমের চোখগুলোও পাপনের মত ভয় পেয়ে এমন অদ্ভুত হয়ে যেত।