পৃষ্ঠাসমূহ

উম্মে মুসলিমার 'হ-য-ব-র-ল'

পত্রিকার বিভিন্ন সাময়িকীর সুবাদে উম্মে মুসলিমার লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কালের খেয়ায় প্রকাশিত লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছি বিগত দিনে। প্রতিটি লেখা ('ডার্করুম সহকারী' 'অসম' 'সৌদি চুড়ি') পড়ার শেষে বারবারই মনে হয়েছে তার প্রেেিত কিছু লেখি। কিন্তু সেই কাজটি হয়ে উঠেনি মূলত অলসতার কারণে। যাইহুক, এবার ৬৪-তম সংখ্যায় তাঁর লেখা গল্প 'জেবুনি্নসা' পড়ে মনে হল সত্যিই কিছু লেখা দরকার।

জেবুনি্নসা গল্পের শুরু এভাবে, 'আরতি রানী দত্ত ম্যাট্রিক পরীার পরপর বাড়ি থেকে উধাও।' অথর্াৎ গল্পের শুরুতে পাঠকদের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, আরতি যখন পরীা দেয় তখন দেশে ম্যাট্রিক (ম্যাট্রিকুলেশন; এস,এস,সি নয়) ধারণা প্রচলিত। তার মানে ঘটনার সময়কাল নির্দেশ। তবে আরো একটি জায়গায় সময়কালের ধারণা পাওয়া যায়। গল্পের চরিত্র সাবু (সাবুদ্দিন) সমর্্পকে লেখক বলেন, 'রামচন্দ্রপুরে ওরকম নায়করাজ রাজ্জাক কাটিং (রাজ্জাক কাটিং?) চেহারা আর ক'জনের আছে?' সুতরাং এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি গল্পের সময়কাল সত্তর থেকে আশি দশকের মাঝামাঝি। তখন অনেক তরুণই নায়ক রাজ্জাক দ্বারা প্রভাবিত হতেন। সেই সময়ের একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আরতি এবং আপাদমস্তক মুসলিম পরিবারের ছেলে সাবুর সংপ্তি প্রেমকে কেন্দ্র করে গল্পের ব্যাপ্তি। আর সেই আরতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, 'মুখখানা যেন ঠিক সরস্বতি ঠাকুরের মতো।(ঠিক বুঝলাম না 'সরস্বতি ঠাকুর' কথাটার মানে কি?) সেই আরতি প্রতিদিন সাবুর দোকানের সামনে দিয়ে স্কুলে যায়। গল্পকার দুজনের মধ্যে প্রেম বুঝাতে শুধু ইঙ্গিত করেছেন, 'সাবুর দিকে আরতি একবার তাকাবে, সাবু তাতে নিশ্চিত ছিল।' এছাড়া যেহেতু প্রেম কি করে হল তার আর কোন ইঙ্গিত নেই, তাই ধরে নিতে পারি লেখক আমাদেরকেও বলছেন যে, এদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে আপনারা নিশ্চিত থাকুন। গল্প থেকে আরো জানা যায় সেই সময়ের একটি মফস্বল এলাকার গঞ্জে আরতির জ্যাঠাতো ভাইয়ের দোকানে এবং সাবুর দোকানে টেলিফোন রয়েছে! সেই টেলিফোনের সাহায্যে জ্যাঠাতো ভাই দোকান থেকে খেতে গেলে আরতি সাবুর সাথে ফোনে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। অথর্াৎ সেই সত্তর-আশি দশকে ফোনালাপে প্রেম! তবুও লেখককে ধন্যবাদ তিনি চরিত্রগুলোর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেন নি! সেই ফোনালাপে আরতি এতই মগ্ন হয় যে ইসলামী নিয়ম-কানুন শিখার জন্য বাজার থেকে নিজেই 'সহজ নামাজ শিা' কিনে আনে! প্রেমাসক্ত আরতি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে ইসলামের জন্য! অবশ্য লেখক এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, 'আরতিরও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কোনো আপত্তি নেই।' সাবুরা এলাকায় প্রভাবশালী। অবস্থাসম্পন্ন মিয়া বাড়ির দরাজ মিয়ার তৃতীয় কনিষ্ঠ পুত্র সে। তার পিতা আবার মসজিদের ইমাম। আর সেই ইমামের ছেলে সাবু ভাগিয়ে নিয়ে আসে আরতিকে নিজের বাড়ি। এদিকে আবার হারিয়ে যাওয়া আরতিকে দুদিনেও খুঁজে পায় না তার পরিবার। পরে আরতির মা মেয়ের বালিশের নিচে থেকে নামাজ শিা এনে তার ভাশুরের ছেলেদের দেখান। (আরতির বাবার কোন উল্লেখ নাই) তা দেখে জ্যাঠাতো দাদা লণ যৌতুকে পাওয়া হান্ড্রেড টেন (হান্ড্রেড টেন! রাজ্জাকের সময়কালে!) মোটরবাইক চালিয়ে সাবুর বাড়ি খুঁজতে আসে। আমরা ল করি যে, গল্পে আরতির দাদা হান্ড্রেড টেন মোটর সাইকেল চালায়, দোকানে টেলিফোনও আছে। অপর দিকে সাবুর বাবা চলাচল করেন ছইওয়ালা মহিষের গাড়ি দিয়ে। এসবের প্রেেিত আসলে কে যে অবস্থাসম্পন্ন; প্রশ্ন জাগে? তারপরও লেখক যেহেতু বলেছেন সাবুর বাবা অবস্থাসম্পন্ন অতএব, সাবুর বাবাই অবস্থাসম্পন্ন। সেই অবস্থাসম্পন্ন কড়া ইমাম (গল্পে উল্লেখ আছে, 'দরাজ মিয়ার কড়া নির্দেশ, তার জীবদ্দশায় কেউ আলাদা হতে পারবে না।) পিতার কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দু মেয়েকে বউ করার জন্য নিয়ে আসায় তিনি খুবই পুলকিত! তার পুলকের বর্ণনা পাওয়া যায় আরতিকে খুঁজতে আসা জ্যাঠাতো ভাইয়ের সাথে কথোপকথনে। তিনি তাকে সাবুর বন্ধু ভেবে বলেন, 'ও, সাবুর ইয়ার বুঝি আপনি? এত দেরি করলেন আসতে? আজতো আমার সাবুর বৌভাত। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি তসরিফ রাখুন। হাতে মুখে পানি দেন। আমি আগে খানার ব্যবস্থা করি।' পরে যখন তিনি আরতির জ্যাঠাতো ভাইকে চিনতে পারেন, তখন সাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'তোর বড় কুটুম বুঝি? আরে আপনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত মেহমান।...সাবু তুই আমার জেবুনি্নসা মাকে নিয়ে আয়' অথর্াৎ এই ফাঁকে বিয়ে হয়েছে। আরতির নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে জেবুনি্নসা। সেই জেবুনি্নসা কি সাবলীল ভাবে তার জ্যাঠাতো ভাইয়ের সামনে এসে বলে, 'মা-বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করবে। আমি খুব ভাল আছি।' এই তার পরিবারের সাথে শেষ আলাপ। পরবর্তি অংশে চলে জেবুনি্নসা ওরফে আরতির মুসলিম রীতি-নীতি আত্নঃস্থ করার পালা।



সাবুর বাবার উদারতা মুগ্ধ হওয়ার মত। তবে আমরা তো এই সমাজেরই মানুষ। তাই সমাজের মানুষগুলোর বৈশিষ্ঠের কথা কম বেশী সবার জানা আছে। আজ এই একবিংশ শতাব্দিতেও দরাজ মিয়ার মত উদারপন্থি ইমাম, যে কিনা মহা খুশিতে তার হিন্দু পুত্রবধূকে বরণ করে নেয়; চোখে পড়ে না। আর সময়টা যদি হয় সত্তর-আশির দশকের মফস্বল_ তবে তো কথাই নেই। গল্পের আরো কিছু ব্যাপার অবাক করে দেয়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে ঢাক বাজিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করে আসছে। কিন্তু তা বাজানো হয় কিছু নির্দিষ্ঠ সময়ে। যেমন, ষষ্ঠীতে সন্ধ্যার পর ঢাক বাজিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে পূজা মন্ডপগুলোতে বোধন সম্পন্ন করা হয়। এই রীতি হয়তো মুসলমান অধূ্যসিত এলাকায় রমজান মাস হলে সময়ের কিছুটা এদিক সেদিক করে পালন করা হয় কিন্তু কখনোই তা ভোরে চলে যায় না। গল্পকার যখন লেখেন, 'পরদিন ষষ্ঠী। ঠাকুর ভিটেয় উঠবে। ভোরবেলা ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বুকের মধ্যে বাদ্য বেজে উঠল...' তখন বাদ্য আমাদের বুকেও বেজে উঠে আর তা হচ্ছে বিস্ময়ের! আর বিস্ময় নিয়ে ভাবি, একি অন্য রীতির প্রতি লেখকের অবহেলা নাকি অজ্ঞতা? অজ্ঞতাই বা বলি কি করে!

গল্পটা পড়ে কি বুঝা গেল কিংবা কেন লেখা হল; তার কোনো উত্তর মিলে না। এই গল্পের উদ্দেশ্য কি প্রশ্ন করলে যদি উত্তর হয় জেবুনি্নসা ওরফে আরতির মাধ্যমে রমজান মাস উপল েপাঠকদের আবারো ইফতারের দোয়া (গল্পে আরতির মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ ইফতারের দোয়া পড়িয়েছেন গল্পকার) মনে করিয়ে দেয়া তবে বলল উদ্দেশ্য একেবারে সফল। ধান ভানতে শিবের গীতটা একটু বেশী গাওয়া হল; এই যা। আর যদি গল্পের শিল্পমূল্যের দাবী উঠে তবে কিন্তু পাঠক নিরুপায়।
প্রকাশক কিংবা সম্পাদকের অনুরোধে অনেক লেখকই লেখা তৈরী করেন। 'জেবুনি্নসা' গল্প পড়ে মনে হয়েছে যেন লেখককে কেউ বলেছেন_ সামনে রোজা এবং পূজা। এই পূজা আর রোজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারকে নিয়ে একটি প্রেম জাতীয় লেখা তৈরী করুন; যা পাবলিক খাবে। আর যেহেতু আপনি মুসলমান এবং মুসলিম প্রধান দেশ সুতরাং সে ধর্মই যেন প্রাধান্য পায়। এরকম ঘটনা যদি অন্য যেকোন সাময়িকীর েেত্র ঘটতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কালের খেয়াকে কেন্দ্র করে আরোপিত, ফরমায়েসি লেখক গড়ে উঠুক; এমনটা কখনোই কাম্য নয়।
আমরা যারা পাঠক তারা জানি, গল্পকারকে সমাজ, সময়, সংস্কার ও কাহিনী বর্ণনায় সজাগ থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় লেখাটা যেন শুধু শুধু কলমের টানে এগিয়ে না গিয়ে বিবেক-বোধ, যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই সাথে পাঠকের আস্থা ও চাহিদাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিশ্বস্থভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনও রয়েছে। আরোপিত কাহিনী পাঠকরা চীরকালই প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই সাথে সাথে লেখককেও। কিন্তু এমনটা যেন উম্মে মুসলিমার েেত্র না ঘটে। কারণ এই গল্পকারের লেখার মত পর্যাপ্ত মতা আছে। শুধু মতাটা একটু যাচাই করে একটা গল্প তাঁর কাছে যতটুকু সময় দাবী করে সেই অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত। আর একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে তাঁর কাছে এটুকু দাবী নিশ্চয়ই করতে পারি?