পৃষ্ঠাসমূহ

বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও অর্ধসত্য রাজনীতি

বাঙালি সমাজ ও ইউরোপীয়ান সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে তফাৎ অনেক। একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠার পর আরেকটা নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াটা সহজ নয়। ফলে একজন বাঙালির নি:সঙ্গ প্রবাস জীবন খুবই কষ্টের। জার্মানির এক বছরের জীবনে বহু বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়েছে। পরিচয় ঘটেছে অনেকের সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কের দৃঢ়তা বা গভীরতা খুব কম জনের সাথেই হয়েছে। আবার বাঙালি সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষ আমরা। আমাদের মধ্যে হিংসা, জেলাসি, পরনিন্দা এসব দ্রুত ডালপালা ছড়ায়। রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর পছন্দ-অপছন্দের ওপর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার এসব কর্মকান্ডের ওপর পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরে। বাঙালিরা সচরাচর কর্মের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণকর দিক নিয়ে কারও মূল্যায়ণ করেন না। কে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত? সেটার ওপরই নির্ভর করে অনেকে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
বাস্তব জীবনে এটার সত্যতা অনুবাধন করলাম এই প্রবাসে এসে। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলতে পারি না। এক্ষেত্রে জীবন্ত উদাহরণ দিতে পারি আবদুল্লাহ আল-হারুণের। যিনি তিন দশক যাবত জার্মানে বসবাস করছেন। তার মত মানুষদেরকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! অথচ যিনি বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। যা থেকে বাঙালি সমাজ বঞ্চিত হলো। তিনি যদি বাংলাদেশে থাকতেন? হয়ত আজ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন কিংবা হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়িয়ে যেতেন! কিংবা খ্যাতিমান প্রয়াত নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনের খ্যাতিকেও ছাপিয়ে যেতে পারতেন তার কর্মগুণে। আবদুল্লাহ আল-হারুণ অবশ্য তারই অনুজ সহোদর। আবার কেউ যদি রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী অংশের অপছন্দের হন। অথবা যিনি ডান পক্ষেও নেই আবার বামপক্ষেরও নন। বাঙালি হিসেবে তার মত অভাগা বোধহয় এজগতে আর কেউ নেই। বাংলাদেশের মত সমাজে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলে টিকে থাকা খুবই কঠিন। সম্প্রতি বার্লিনে আমাকে এই সত্যটা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের এক সুহৃদ।
যাহোক, আজকের লেখার প্রসঙ্গ এটা নয়। লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুণ প্রবাস জীবনে আমার একজন বড় বন্ধু, অভিভাবক। তার সাথে আমার বয়সের দিক ধরলে বলতে হবে পিতা-পুত্রের মত সম্পর্ক। তার মাধ্যমেই কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে আমার। তিনি অনলাইন সংবাদপত্র নতুন দেশ এর প্রকাশক এবং তার স্ত্রী সেরিন ফেরদৌস সম্পাদক। উভয়ই পেশাদার সাংবাদিক। বাংলাদেশে থাকতে কারও সঙ্গেই আমার সরাসরি যোগাযোগ হয়নি কোনদিন। কিন্তু উভয়ের রিপোর্টই আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। তাদের রিপোর্টের সঙ্গে ছিল আমার এক ধরণের গভীর সম্পর্ক। নতুন দেশে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল হারুণের একটি লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করি। এটা করতে গিয়ে শওগাত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ই-মেইল যোগাযোগের মাধ্যমে। খুব বেশিদিনের কথা নয় এটি। মার্চের ১০ কিংবা ১২ তারিখে (২০১০) প্রথম যোগাযোগ সাগর ভাইয়ের সঙ্গে। নতুন দেশ পত্রিকার প্রথম বর্ষ সংখ্যা ৩৮, ২১ এপ্রিল, ২০১০ সংখ্যায় একটি লেখা ছাপা হয় জনৈক আবুর রহিম মজুমদারের নামে। শিরোনাম ছিল বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন।
ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন সংক্রান্ত যেকোন ধরণের রিপোর্ট বা লেখার প্রতি আমার আগ্রহ একটু বেশি। তাই লেখাটি মনোযোগ আকর্ষণ করে আমার। কিন্তু প্রথম প্যারা পড়ার পরই লেখার সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক মনে হতে লাগলো। এবং লেখাটি পুরো একবার পড়ার পরই বুঝতে পারি এটা আমার লেখা। হুবহু আমার এই লেখাটিই ভিন্ন শিরোনামে ছাপা হয় বাংলাদেশের প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদে। সেই আমার লেখাটি ছাপানো হয় নতুন দেশে। ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত আমার লেখাটির শিরোনাম ছিল ”সাহসী সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা দিবস এবং বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন”। দ্রুত একটা ই-মেইল পাঠালাম সাগর ভাইকে। তিনি স্বস্তিমূলক একটা উত্তর দিলেন তড়িৎ বেগে। তারপরেই দেখা গেলো লেখাটি ডিলিট করে দেয়া হয়েছে। আমি যদি কারও লেখা হুবহু নকল করে নিজের নামে কোথাও পাঠাই। তবে কোন সম্পাদক-বার্তা সম্পাদক বা প্রকাশকের পক্ষেই তা আঁচ করা সম্ভব নয়। নকল বা চুরির বিষয়টি তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষপে নিশ্চিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। যেটা বাস্তবে করে দেখালেন প্রিয় শওগাত ভাই ও সেরিন আপা। পেশাদারি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটা একটা নজির। ধন্যবাদ নতুন দেশ কর্তৃপক্ষকে। নতুন দেশ পরিবারের সাথে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করি আমি। আশা করি এই সম্পর্কের ধারা বহমান রইবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ও প্রিয় পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের প্রেসফ্রিডমের একটা চিত্র তুলে ধরতে চাই। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে মাত্র। তখন আমি কলেজে পড়ি। শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে কাজ করি দৈনিক বাংলায়। তখনই দৈনিক বাংলা কার্যালয়ে পরিচয় দু:সাহসী দেশপেমিক সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় শামছুর রহমান কেবলের সঙ্গে। ১৬ জুলাই তাঁর হত্যাবার্ষিকী। ২০০০ সালের এই দিনে দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যা করে বুলেটের আঘাতে। তখন তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করেন যশোর থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন করার লক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এরপর দৈনিক বাংলা ছেড়ে যোগ দিই দৈনিক সংবাদে। তখন পরিচয় হয় সাংবাদিক মানিক সাহার সঙ্গে। খুলনা থেকে তিনি সাংবাদিকতা করতেন। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভয়াবহ সন্ত্রাস, তান্ডব দেশবাসিকে ভাবিয়ে তুলতো। এই অপশক্তি আমাকে বারবার হত্যার হুমকি দেয়। মানিক সাহা বলতেন, ”আকাশ বেশি রিস্ক নিও না। সাবধানে থেকো। ওরা (শিবির) খুব ভয়ংকর।” এই অকুতোভয় জনদরদী সাংবাদিক আর নেই আমাদের মাঝে। বোমার আঘাতে এই দেশপ্রেদিকের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তচক্র। আজও জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে মানিক সাহার সেই রক্তাক্ত ছবিটা। তার মাথার মগজ সেদিন উড়ে গিয়েছিল বোমার আঘাতে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল তার দেহটা। রাস্তার ওপরে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেহ যেন গোটা বাংলাদেশ। পর্শিয়া ও নাতাশাতো আর কোনদিন বাবা ডাকতে পারবে না। মানিক সাহার দুই কন্যা। নন্দা বউদির চোখের জল মুছে গেছে। কিন্তু হৃদয়ের যে ক্ষরণ তা কী কোনদিন বন্ধ হবে?
মুক্ত গণমাধ্যমতো পরের কথা সাংবাদিকদের জীবনেরই কোন নিশ্চয়তা নেই। সন্ত্রাস, রাজনীতি ও সমাজনীতির সব তথ্যের জীবন্ত ভান্ডার ছিলেন কেবল ভাই। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জীবনে দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে নতুন বছর আসে। কিন্তু সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের বিচার হয় না। দেশে ”সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক” নামধারী একটা নির্বাচিত সরকার আছে। এটা আবার মহাজোট সরকার নামে বেশি পরিচিত। কিন্তু সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বন্ধ করা যায়নি বিনা বিচারে মানুষ হত্যা। মাত্র ক’দিন আগে চলে গেলো ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাসের হত্যা দিবস। আদালতে আত্মসমর্পণকারি একজন অভিযুক্ত খুনি (গৌতম হত্যার) কী করে পালিয়ে যায়? এটা আমাদের জানা নেই। তবে দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার আছে বলে মনে হয় না। থাকলে অন্তত সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হতো। বিচার পেতো নির্যাতিত ও নিহত সাংবাদিক পরিবারগুলো।
গণতন্ত্র ছাড়া গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। মানবাধিকারও থাকে না। অসাম্য আর অন্যায্যের পৃথিবীতে সাংবাদিকতা দিন দিন ঝঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও অশান্ত দুনিয়ায় সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন নতুন কোন বিষয় নয়। তাইতো বিশ্বময় প্রেসের স্বাধীনতা তথা প্রেস ফ্রিডম বা মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য আওয়াজ তীব্র হচ্ছে ক্রমশ:। এই আওয়াজ গণমাধ্যমের গন্ডি পেরিয়ে নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশকেও টানতে সক্ষম হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অসহায়। গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপুরক। বিশ্বে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকতার ঝুঁকিটা চরমে পৌঁছেছে। আর বাংলাদেশেতো প্রায় প্রতিনিয়ত সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম রাষ্ট্রযন্ত্রের খবরদারি, নিপীড়নের মধ্যেই আছে।
জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে রক্ষা করা গণমাধ্যমের প্রধান কাজ। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। অধিকারহারা শোষিত বঞ্চিত অসহায় মানুষদের পক্ষে গণমাধ্যম সর্বদা সোচ্চার। সমাজপতি, রাষ্ট্রনায়কদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে গণমাধ্যম। সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সাংবাদিকরা শত প্রতিকুলতার মধ্যেও কাজ করছেন। বাংলাদেশে তিন’টি জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা লুটপাট নিয়ে খবর বেরুলেই হলো। সাংবাদিক আর যায় কোথায়? সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের খবর হয়ে যাবে। একই কারণে সাংবাদিককে মন্ত্রি-এমপিদের অথবা রাজনৈতিক প্রভাবশালি মহলের খপ্পড়ে পড়তে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের, প্রভাবশালিদের রোষানলে পড়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হত্যা-নির্যাতন, হয়রাণি, গ্রেফতার, মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে বন্ধুর করে তুলেছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকদের জন্য জীবন খুব বিপদজনক। কারণ সাংবাদিকরা মানুষের কথা বলেন। মানুষের বিপদ হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করে গণমাধ্যম। রাজনৈতিক দূুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি-দু:শাসনের কথা তুলে ধরেন সাংবাদিকরা। ফলে সাংবাদিকদের উপরেই সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের কষাঘাত এসে পড়ে। যেসমস্ত সাংবাদিক বা মিডিয়া মানুষের নিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলতে চেষ্টা করেন। কিংবা যারা মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেন তাদের উপরেই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার নেমে আসে। এখানে আমরা উদাহরণ দিতে পারি একুশে টেলিভিশন (বন্ধ হবার আগেকার একুশে টিভির কথা বলা হচ্ছে) এবং সিএসবি নিউজ এর। একুশে টিভি এবং সিএসবি নিউজ এই দু’টি টিভি চ্যানেল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ছল-ছুতোয় সরকার এই বৃহৎ দু’টি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও আদালতের রায়ের মাধ্যমে পরে একুশে টেলিভিশন পুনরায় চালু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রেসফ্রিডম এর আরও খবর হলো আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার টেলিযোগাযোগ আইন লংঘন’র অভিযোগে চ্যানেল ওয়ান এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় ২৭ এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যায়। (সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ২৮ এপ্রিল, ২০১০)। একই দিনের সংবাদ’ এর দেশ পাতায় আরেকটি খবরের শিরোনাম হলো ”মানিকগঞ্জ সংবাদ প্রতিনিধিকে পৌর মেয়রের প্রাণনাশের হুমকি: থানায় জিডি”।
রিপোর্টের ভাষ্য মতে, দুর্নীতি বিষয়ক একটি অভিযোগের বিষয়ে মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা রমজান আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন সাংবাদিক মুহম্মদ আবুল কালাম বিশ্বাস। এসময় মেয়র সাংবাদিককে বলেন, ”তুই যদি আর পত্রিকায় আমার ও আমার পরিবার নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ করিস তবে তোকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। আগেও তুই আমার ভাইকে নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেছিস। আমি তখন আমার লোকজন নিয়ে তোকে খুঁজেছি, কিন্তু তোকে পাইনি। তাই তুই প্রাণে বেঁচে গেছিস। পত্রিকায় আর যদি কোন সংবাদ আমাকে নিয়ে লিখিস, তাহলে আমি তোর ও তোর পরিবারের ক্ষতি করবো।”
বাংলাদেশে প্রেসফ্রিডমের সর্বষে খবর হলো-দৈনিক আমার দেশ এর প্রকাশনা বন্ধ। ১ জুন, ২০১০ সরকার এক ঠুনকো অজুহাতে বিরোধী শিবিরের সমর্থক এই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। একই রাতে সরকার আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে (যদিও তিনি পেশাদার কোন সাংবাদিক নন, তবে বাংলাদেশে বহু অপেশাদার মানুষ মিডিয়া অঙ্গনের নামকরা ব্যক্তিত্ব) গ্রেফতার করে। বাংলাদেশের প্রাচীন ইংরেজী দৈনিক অবজারভার বন্ধ হয়ে গেছে জুন (২০১০) মাসেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীরে নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারই ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু করে। কিন্তু কথিত অনিয়মের অভিযোগে ১৯ নভেম্বর, ২০০০৯ সরকার যমুনা টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের শেষ নেই। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন যেন এক মামুলি ব্যাপার সেখানে। ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ে দৈনিক সমকালের বিপ্লবের হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হয় জোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই। অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্যের প্রত্যক্ষ মদদে এ ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ। সেই ঘটনার সর্বশেষ কী অবস্থা তা আমরা আজও জানি না। ঢাকার উত্তরায় কমিউনিটি বেইসড একটি পত্রিকার তরুণ রিপোর্টার নূরুল ইসলাম রানা খুন হয়েছেন। এটা ২০০৯ সালের ৩ জুলাইয়ের ঘঁনা। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলই ৫ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। নিহত সাংবাদিকরা হলেন ফতেহ ওসমানী, শফিকুল ইসলাম মিঠু, আবদুল হান্নান, আহসান বারী ও নূরুল রানা। আর জরুরি অবস্থায় এই লেখক (জাহাঙ্গীর আলম আকাশ) ছাড়াও দ্য ডেইলি স্টারের তাসনীম খলিল নির্যাতিত হন সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের হাতে। জরুরি অবস্থা চলাকালে সিলেট, বান্দরবান, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিদের বিরুদ্ধে হয়রাণিমূলক মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর সামরিক শাসন দেশের মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে। বহু লড়াই-সংগ্রাম আর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। মুক্তি পায় গণতন্ত্রের পায়রা। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মানুষ ফিরে পায় স্বাধীনতার পুন:স্বাদ। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপি। ক্ষমতায় এসেই বিএনপি সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। সরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা, গণমাধ্যম থেকে বিএনপির কাছে ‘অপছন্দনীয়’ সাংবাদিকরা গণছাঁটায়ের শিকার হন। কোন রকমের টার্মিনেশন বেনিফিট ছাড়াই বিএনপি সরকার ছাঁটাই করে দৈনিক বাংলার তৎকালীন সম্পাদক তোয়াব খান, তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবিরসহ ১৪ জন সিনিয়র সাংবাদিককে।
২০০২ সালের নভেম্বর মাসের কথা। বিবিসি চ্যানেল ফোরের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন বিদেশী সাংবাদিক জাইবা মালিক ও ব্রুনো সরেনটিনো। এই ’অপরাধে’ বিএনপি সরকার সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন করে। ব্রিটিশ ও ইতালীয় এই দুই সাংবাদিকসহ বাংলাদেশের শাহরিয়ার কবির, সালিম সামাদ ও পিসিলা রাজকে গ্রেফতার করা হয়। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এর সাথে জড়িত করে গ্রেফতার করা হয় বাসস’র সাংবাদিক এনামুল হক চৌধুরী ও বিশিষ্ট কলামিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনকে। আটকাবস্থায় বিএনপি সরকার সাংবাদিকদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল বলে অভিযোগ।
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকের ঘটনা। দৈনিক সংবাদের ধামরাই প্রতিনিধি শামীম পারভেজ খানকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় দুর্বৃত্তরা। এলাকার নিরীহ লোকদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে সহায়তা করার করেন এই সাংবাদিক। এতেই ক্ষুব্ধ হয় স্বার্থান্বেষী মহল। হুমকির বিষয়ে থানায় জিডি হলেও সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হয়নি। একই মাসের শুরুর দিকে ঘটে আরেক ঘটনা ময়মনসিংহে। গফরগাঁওয়ে দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি শামীম আল আমিন বিপ্লবের ওপর আক্রমণ করা হয়। সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ এর ক্যাডার বাহিনী বিপ্লবের হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। ২২ অক্টোবর (২০০৯) বাড়ির ভেতরে বর্বর নির্যাতনের শিকার হন সাংবাদিক এফ এম মাসুম। র‌্যাব সদস্যরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে। তিনি নিউ এজ পত্রিকার রিপোর্টার। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। যার কারণে তাকে নির্যাতিত হতে হয়।
২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল মাস। চট্রগ্রামে বাংলাদেশ ও অষ্ট্রেলিয়ার মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। খেলার মাঠের তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ চালায় নির্মমতা। পুলিশ বাহিনী সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের তৎকালীন ডিসি আলী আকবরের নেতৃত্বে অন্ত:ত ৩০ জন সাংবাদিক আহত হন। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত প্রবীণ আলহাজ্ব জহিরুল হক। তাকেও সেদিন পুলিশ যেভাবে আক্রমণ করেছিল তা কোন সভ্য সমাজে ভাবাই যায় না। পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে সাংবাদিকদের পিটিয়েছে। সাংবাদিক সমাজের আন্দোলন তুঙ্গে এই ঘটনার প্রতিবাদে। তখন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করেছিল। সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। হামলাকারী পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা কেউই শাস্তি পাননি আজও।
২০০৬ সালের ২৯ মে। কুষ্টিয়ায় তৎকালীন সরকার দলীয় সেখানকার সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের ওপর লেলিয়ে দেয় সন্ত্রাসী। সেই ক্যাডার বাহিনী হামলা করে সাংবাদিকদের সমাবেশে। নির্যাতনবিরোধী ওই সমাবেশে হামলায় গুরুতর আহত হন বিশিষ্ট সাংবাদিক বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমাদের স্মৃতিতে আজও সেই রক্তাক্ত ইকবাল সোবহান চৌধুরীর ছবি ভেসে ওঠে। সন্ত্রাসী ক্যাডারদের কোন শাস্তি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
সাংবাদিকতাই আমার পেশা এবং নেশা। সার্বক্ষণিক ধ্যাণ, চিন্তা-চেতনার মধ্যেই আছে আমার সাংবাদিকতা। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা। জনকল্যাণ ভাবনা। মানুষের ওপর যে অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার। এসব নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই হলো আমার জীবনের জন্য কাল। নন পার্টিজানশিপ সাংবাদিকতা করার এবং সর্বদাই ইনভেষ্টিগেটিভ জার্নালিজম করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি কখনই ভাবতে পারি না নির্যাতিত হবো নিজেই। কল্পনাও করিনি কোনদিন এমনটা। অন্যায়-অবিচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে নিজেই রাষ্ট্রীয় বর্বরতার শিকার হলাম।
অন্যায়-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি রিপোর্ট করেছি। সেইরকম নির্যাতনই আমার জীবনটাকে পাল্টে দেবে? এটা ভাবনায় ছিল না আমার। আজকে আমি একটা কঠিন বাস্তবতা কিংবা সত্যের মুখোমুখি। এক ধরনের একটা অনিশ্চয়তা একটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে আমার জীবনটাকে। আমি জানি না এ অবস্থার অবসান হবে কিনা? কারণ আমরা একটা অসভ্য-বর্বর সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। একটা অপশক্তি এই সমাজকে সবসময় অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে অপশক্তি দিন দিন সমাজকে আবৃত করে ফেলছে। আমরা জানি, শত হয়রাণি, নির্যাতন ও হুমকিতেও জনজোয়ারের ঢেউ আটকানো যায় না। তেমনি কোন কোন মানুষকে আদর্শচ্যুত করা যায় না। অত্যাচার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও অপশক্তি কখনই সত্যকে নিভিয়ে দিতে পারে না। তেমনি বাংলাদেশের সত্যান্বেষী কলম সৈনিকদেরর দমানো যাবে না হত্যা-নির্যাতন করে।
বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে আমাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই নির্যাতন জড়িয়ে আছে। অত্যাচার বা নিপীড়ন বিষয়টা শক্তভাবে গ্রোথিত। মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই (ব্যতিক্রম ছাড়া) নিয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্রসফায়ারের মত মানব হত্যার জঘন্য ঘটনাকে। পুলিশ, র‌্যাব বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হেফাজতে হত্যা-নির্যাতন একটা সাধারণ ব্যাপার। নির্যাতনের প্রেক্ষিতে মৃত্যুর পরও সমাজ কোন উচ্চবাচ্চ করে না। সরকার সবসময় এসব অপকর্মকে বৈধতা দিয়ে আসছে। অন্যকথায় দায়মুক্তি দিচ্ছে। নির্যাতনকারি-খুনির দল হচ্ছে পুরস্কৃত। এখানে মিডিয়ার ভূমিকাও প্রশ্নবোধক। মিডিয়া তোতাপাখির ন্যায় ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পক্ষ নিচ্ছে। মিডিয়া বাধ্য হয়ে করুক আর স্বেচ্ছায় করুক এটা দেখছি আমরা। ক্রসফায়ারকারিদের প্রেসবিজ্ঞপ্তিটি ছেপে দিতে কার্পণ্য করে না আমাদের গণমাধ্যম। অবশ্য যারা সাহস নিয়ে দু’একটি রিপোর্ট করেন তারা পড়েন চরম বেকায়দায়। তাদের হয় নির্যাতিত না হয় চাকুরিচ্যুত হতে হয়।
জাতির বিবেক, জাতিকে যারা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তারাই হলেন সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী। সেই সাংবাদিকদের উপরে র‌্যাবের নির্যাতন চরমে এসে পৌঁছায় জরুরি অবস্থার সময়ে। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমি নিজেই। আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের উদাহরণ অনেক আছে। আমাদেরই সাহসী সাংবাদিক বিশিষ্ট কলামিষ্ট মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব শাহরিয়ার কবির স্বয়ং এক বড় উদাহরণ। শাহরিয়ার কবিরের ওপর বর্বর রাষ্টীয় নির্যাতন হয়েছে। আজও তিনি তার শরীরে সেই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একই অবস্থা এই লেখক এবং নিউ এজ এর মাসুমের। কিন্তু তারপরও আমরা চাই, আর কেউ যেন নির্যাতনের মাধ্যমে কিংবা বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার না হয়। দেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের কিঞ্চিৎ খতিয়ান তুলে ধরা যাক এবার। মানিক সাহা ছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক। তিনি দৈনিক সংবাদ, নিউ এজ, বিবিসি ও বন্ধ হয়ে যাওয়া একুশে টেলিভিশন এর প্রতিনিধি ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তার পর বর্বর ও নৃশংস বোমা হামলা চালায় ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ফলে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন খুলনা প্রেসক্লাবের অনতিদূরে। এমন নৃশংস কায়দায় সাংবাদিক হত্যার নজির নেই আমাদের দেশে। মানিক সাহা হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশ জুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকান্ডের প্রকৃত খুনিরা আজও ধরাছোয়ার বাইরে।
২০০৪ সালের ২ মার্চ দি নিউ এজ পত্রিকার খন্ডকালীন সাংবাদিক কেরানীগঞ্জের আবদুল লতিফ নাবিলকে জবাই করে হত্যা করা হয়। স্ত্রী ফারহানা সুলতানা কনকের পরকীয়া প্রেমে বাধা দেয়ার কারণে এই হত্যাকান্ড ঘটে বলে অভিযোগ। স্ত্রীর প্রেমিক নির্জন মোস্তাকিন, মোস্তাকিনের বন্ধু শহিদুল ইসলাম পাপ্পু ও নাবিলের স্ত্রী কনক মিলে নাবিলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তীতে মোস্তাকিন, পাপ্পু ও স্ত্রী কনককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে মামলার কী অবস্থা? এটা আমাদের জানা নেই। দৈনিক জন্মভূমি সম্পাদক ও খুলনা প্রেসক্লাব সভাপতি ছিলেন হুমায়ূন কবির বালু। ২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনায় সন্ত্রাসীরা বোমা মেরে হত্যা করে তাকে। একই সালের ২১ আগস্ট রাতে সন্ত্রাসীরা কামাল হোসেনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করে হত্যা করে। তিনি ছিলেন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির আজকের কাগজ প্রতিনিধি ও উপজেলা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক।
বগুড়ার দূর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক ও বিএফইউজে সহ-সভাপতি দীপংকর চক্রবর্তী (৫৯)। তাকে একই বছরের ২ অক্টোবর হত্যা করা হয়। শেরপুরের সান্যালপাড়ার নিজ বাড়ির পাশেই সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এই সৎ সাংবাদিককে। ঢাকার কাঁটাবনে ২০০৪ সালের ২৪ অক্টোবর নিহত হন আরেক সাংবাদিক। দৈনিক এশিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা অফিসে ঢুকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আনোয়ার অ্যাপোলো (৩৫) কে। অ্যাপোলো ওই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক বলে তার পকেট থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে বলে জানা গেছে। ২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে দৈনিক সংগ্রাম’র খুলনা ব্যুরো প্রধান শেখ বেলালউদ্দিনকে নিহত ও আরও ৪ সাংবাদিক আহত হন। একই বছরের ২৯ মে দিবাগত মধ্য রাতে কুমিল্লায় দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মুহাম্মদ গোলাম মাহফুজ (৩৮) নিহত হন। তাকে জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তরা।
সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন ফরিদপুরে সমকালের প্রতিনিধি গৌতম দাস, যশোরে দৈনিক রানারের গোলাম মাজেদ, খুলনায় হারুন-অর রশিদ খোকন, দৈনিক জন্মভূমির হুমায়ুন কবির বালু, দৈনিক সংবাদের মানিক সাহা, রাঙ্গামাটির জামালউদ্দিন, ঝিনাইদহের মীর ইলিয়াস হোসেন দিলীপ, দৈনিক সংগ্রামের শেখ বেলালউদ্দিন, নহর আলী, শুকুর আলী হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আহসান আলী, মৌলভীবাজারের ফারুক আহমেদ, নীলফামারীর নীলসাগরের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, সাতক্ষীরার শ.ম.আলাউদ্দিন, যশোরের দৈনিক জনকণ্ঠের শামছুর রহমান কেবল, সাইফুল আলম মুকুল। সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নির্যাতনের একটি ঘটনায়ও নির্যাতনকারির শাস্তি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। জোট আমলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে বিশিষ্ট কলামিষ্ট অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, এনামুল হক চৌধুরী সালিম সামাদ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জোট আমলে নির্যাতিত হয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলহাজ্ব জহিরুল হক। নির্যাতিত হয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, টিপু সুলতান।
বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক ডক্টর হুমায়ূন আজাদসহ ৩১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ২০০৯ সালের ৩ জুলাই সাংবাদিক নূরুল ইসলাম রানা সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন ঢাকার উত্তরায়। বর্তমান সরকারের আমলে নিহত হয়েছেন সাংবাদিক আবদুল হান্নান (ডেমরা, ঢাকা) ও এম এম আহসান বারী (গাজীপুর, ঢাকা)। বেসরকারি সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট মতে, ২০০৯ সালে দেশে ৩ জন সাংবাদিক নিহত, ৮৪ জন আহত, ৪৫ জন লাঞ্ছিত, ১৬ জন আক্রান্ত, একজন গ্রেফতার, দুইজন অপহরণ, ৭৩ জন হুমকির শিকার, ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ১৯ জন অন্যান্য ঘটনায় আক্রান্ত হন। ৪১ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ৩৮ জন সাংবাদিক আহত, ২৬ জন হুমকির শিকার, ১৭ জন লাঞ্ছিত, একটি সংবাদপত্র কার্যালয় ও ৮ জন সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে তৎকালিন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী সাংবাদিক পিটিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় ওঠে আসেন। বার্তা সংস্থা ইউএনবির তৎকালিন ফেনী প্রতিনিধি টিপু সুলতানের ওপর হাজারীর ক্লাস কমিটির সদস্যরা হামলা করে। তখন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রি (যিনি বর্তমানেও প্রধানমন্ত্রি) শেখ হাসিনা পরোক্ষভাবে সাংবাদিক নির্যাতনকারির পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, টিপু সুলতানের কী কোন এক্রিডিটেশন কার্ড আছে? ওটা ছাড়া কী সাংবাদিক হওয়া যায় নাকি? অথচ বাংলাদেশের শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ সাংবাদিকের কোন এক্রিডিটেশন কার্ড নেই। যদিও এই কার্ড দেয়া নিয়েও রয়েছে নানান কথা। সে প্রসঙ্গ থাক আজ।
দেশে আলোচিত সাংবাদিক হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও বহুল আলোচিত হলো মানিক সাহা, শামছুর রহমান কেবল, হুমায়ুন কবির বালু, দীপংকর চক্রবর্তী, গৌতম দাস, হারুন রশিদ খোকন, সাইফুল আলম মুকুল, শেখ বেলালউদ্দিন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহু সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। এরমধ্যে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক প্রকাশক মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, জাহাঙ্গীর আলম আকাশ, তাসনীম খলিল, কার্টুনিষ্ট আরিফুর রহমান প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের তুচ্ছ ঘটনা ঘটে। এরই জের ধরে সেনাবাহিনী দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী মৌন মিছিল করেন। এই অজুহাতে তৎকালিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নামে রাজনৈতিক হয়রাণিমূলক মামলা চাপিয়ে দেয়।
প্রথাবিরোধী বিশিষ্ট নাট্যকার-অভিনেতা, কলামিষ্ট মলয় ভৌমিক। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করেছেন। এখন নিয়মিত কলাম লিখেন দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তরসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে। তার ”উত্তরের উলুখাগড়া” শীর্ষক কলাম দৈনিক সংবাদ এর জনপ্রিয় কলাম ছিল। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বয়সী নাট্য সংগঠন অনুশীলন নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের চেয়ারম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শায়ত্বশাসিত একটি ক্যাম্পাসে নির্যাতনবিরোধী মৌন র‌্যালি করার অপরাধে বর্বর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তিনি। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হয়নি।
সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাগুলো নতুন নয়। জরুরি অবস্থার সময় সাংবাদিকদের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। সাংবাদিকদের যেভাবে পর্যুদস্ত করা হয়েছে তার প্রতিকার সাংবাদিক সমাজ কার্যকরভাবে চাইতে পেরেছে কিনা? সেটাও আজকে একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সাংবাদিকদের বিভাজন, সাংবাদিকতা পেশার রাজনীতিকরণ, সুশাসনের অভাব, কার্যকর গণতন্ত্রহীনতা, সুবিধাবাদিতা, বৈষম্য, ধনিক পুঁজি অভিমুখী গণমাধ্যমসহ নানা কারণে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের কোন প্রতিকার হয়নি আজও।
সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের প্রতিকার না পাবার পেছনে আরেকটি শক্তিশালী কারণ বিদ্যমান। সেটা হলো-দলীয় সাংবাদিকতা। আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের আমলে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন হলে আওয়ামী তথা মহাজোট সমর্থক সাংবাদিকরা নিরব হয়ে যান। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে যারা সোচ্চার থাকেন রাজপথে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে। অন্যদিকে আবার বিএনপি-জামায়াত আমলে শত সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন হলেও বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাংবাদিক সমাজ মুখে কুলুপ আটে। যারা মহাজোটের আমলে মহাবিপ্লবী সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে।

সাংবাদিক কিংবা সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। যেকোন হেফাজতে কোন নাগরিককে নির্যাতন সভ্য সমাজে চলতে পারে না। সাধারণ নাগরিক হোক অথবা রাজনীতিবিদ হোক কিংবা পেশাজীবি হোন বা গণমাধ্যমকর্মী হোন কারও কোন নির্যাতনের ঘটনা যেন আর না ঘটে। সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে এটা আমাদের দাবি। যদি এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটে তার সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন। যারা এমন নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার কার্যকর তদন্ত চাই। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় দোষিদের বিচারের মুখোমুখি আনয়ন অত্যন্ত জরুরি। কেননা, সভ্য সমাজে মানব হত্যা-নির্যাতন কল্পনাও করা যায় না।
বাংলাদেশের সমাজ যদি আদর্শভিত্তিক পরিবর্তিত না হয় তাহলে প্রেসফ্রিডমটা মূলত: সোনার হরিণ ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশের মানুষ দেখেছেন, দুর্নীতিবাজরা সব সরকারের আমলেই নিয়ন্ত্রিত। আর এসব দুর্নীতিবাজ কিংবা কালো টাকার মালিকরাই বাংলাদেশে মিডিয়ার ওনারশিপের জায়গাটা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মিডিয়াকে ঘোষণা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কালো টাকার মালিক মিডিয়ার ওনারশিপে থাকায় তাদের মধ্যে একেবারেই ব্যতিক্রম ছাড়া কোন ইডিওলজি নেই। ফলে সাংবাদিকরা প্রথমত: সেলফসেন্সরশিপের মুখে পড়ে। সরকারি বিজ্ঞাপনকে ঘিরে দেশে মুড়ি-মুড়কির মত সংবাদপত্র বেরিয়েছে। এর কতগুলো জনগণের কল্যাণে কাজ করছে তাও আজ একটি বড় প্রশ্ন। সরকারের তরফ থেকে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম বড় হাতিয়ার হলো বিজ্ঞাপন। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। তাছাড়া পেশাদারিত্বের সংকট বাংলাদেশে প্রেসফ্রিডমের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বাধা।
দেশে প্রেসফ্রিডমের আরও একটা সমস্যা হলো কনটেম্পট টু কোর্ট এবং মানহানি। এ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা না থাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক-প্রকাশকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠেছে। কোনটা লিখলে আদালত অবমাননা হবে? তার কোন সৃনির্দিষ্ট বর্ণনা নেই কোথাও। এনিয়ে সাংবাদিক, সম্পাদক সকলেই একটা চরম ঝুঁকির মধ্যে। সর্বোপরি বাংলাদেশে কোন জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নেই। জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাব, সাংবাদিদের মধ্যে অনৈক্য, রাজনৈতিক বিভাজন, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন থামছে না। সাংবাদিক খুন বা নির্যাতিত হলে তার প্রতিকার মেলে না, বিচার হয় না। ফলে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনকারিরা উৎসাহিত হচ্ছে। সাংবাদিক সমাজ আমরা দেশে এযাবৎ সংঘটিত সকল সাংবাদিকসহ সকল হত্যা-নির্যাতনের বিচার চাই। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনসহ সকল হত্যা-নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। যদি সমাজে সত্যিকারের আইনের শাসন, কার্যকর গণতন্ত্র থাকে। অত্যাচার-নির্যাতনের কোন প্রতিকার, বিচার, প্রতিবিধান নেই। এই যে একটা ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়েছে সেটাকে ভাঙা চাই। আর এটা করতে হলে চাই দেশপ্রেমিক জনঐক্য।
রাজনীতি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের উর্দ্ধে ওঠে গণ জাগরণ গণবিপ্লব দরকার। গণবিপ্লবের মাধ্যমেই কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরকার সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রে দায়মুক্তি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির শেকড় বেশ গভীরে। এটার প্রমাণ মেলে যখন আমরা দেখি, মানুষ হত্যাকান্ডের বিচার চান না। সহকর্মীর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর সাংবাদিক সমাজকে বলতে শুনেছি ’বিচার পাই না তাই বিচার চাই না’। এমন স্লোগান লিখে রাজপথে নামতে হয় সাংবাদিকদের। আমরা আশা করবো, এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। আশার কথা হলো বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে কমিউনিটি রেডিও নীতিমালা প্রণয়ন করে গেছে। মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি ধাপ এগিয়েছে বলে আমরা মনে করি। তবে এসব আইন প্রণয়ন করলেইতো আর হবে না। এগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে এবং কার্যকর করতে হবে।
বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাসমূহ তুলে নেয়া হবে। ভাল কথা। রাজনৈতিক হয়রাণিমূলক মামলা তুলে নেয়াই উচিত। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক হয়রাণিমূলক মামলা হয়েছে। আমি মনে করি, একটা বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার। সেটা হলো ধরুণ, একজন সাংবাদিক ’এক্স’। তিনি সত্যি সত্যি চাঁদাবাজি কিংবা অপরাধ করেছেন। তার মামলাও কী তবে তুলে নেয়া হবে? এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো-না সব মামলা তোলা উচিত হবে না। কেবলমাত্র যেসব মামলা রাজনৈতিব উদ্দেশ্য প্রণোদিত, মিথ্যা-হয়রাণিমূলক সেইসব মামলাই তুলে নেয়া হোক। অন্যথায় দেশে আইনের শাসন রক্ষা করা যাবে না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র আবার গণতন্ত্র ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। কোনটাই ভাবা যায় না। সভ্য ও মানবিক কল্যাণমুখী সমাজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটা পূর্বশর্ত। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। একটা ছাড়া অন্যটা অচল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের মাধ্যমে আজ (১০ জুলাই, ২০১০) কথা হলো আমার এক বন্ধু-সহকর্মীর সাথে। ফেইসবুক চেটিংকালে ওই বন্ধুটি জানালেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ওপর তিনি চার পর্বের একটি সিরিজ প্রতিবেদন তৈরী করেন। যার অর্ধেক প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু অর্ধেকটা (দু’টি পর্ব)বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সেনাবাহিনীর (র‌্যাব) চাপ। ২০০০ সালের ঠিক এই দিনে (১০ জুলাই) নিহত হয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠের দক্ষিণালীয় প্রতিনিধি ছিলেন। নিজ অফিসে কর্মরত অবস্থায় তিনি সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান। এরপর দশটি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু খুনিদের বিচার হয়নি।
দৈনিক জনকণ্ঠ (১০ জুলাই, ২০১০) লিখেছে, ২০০১ সালে সিআইডি পুলিশ চাঞ্চল্যকর শামছুর রহমান হত্যা মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মামলার বর্ধিত তদন্ত করা হয়। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে নিহত সাংবাদিক কেবলের বন্ধু সাংবাদিক ফারাজী আজমল হোসেনকে আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। আবার বাদ দেয়া হয় মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে। কিন্তু নতুন সাক্ষী করা হয় আসামিদের ঘনিষ্ঠজনদের। ২০০৫ সালের জুন মাসে এই মামলার সকল আসামির বিরুদ্ধে যশোরের ষ্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগ গঠিত হয়। একই বছরের জুলাই মাসে বাদিকে না জানিয়ে মামলাটি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করে সরকার। মামলার অন্যতম আসামি খুলনার সন্ত্রাসী মুশফিকুর রহমান হিরক জামিন নিয়ে পলা
খুলনার আদালতে যাবার পর মামলার বাদি এ বং কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। সে সময় আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে পুলিশ মামলার বাদি এবং সাক্ষীর বাড়িতে অভিযান চালায়। শহীদ শামছুর রহমানের স্ত্রী সেলিনা আকতার লাকি ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে আপীল করেন। আপিলের আবেদনে বলা হয়, মামলার অন্যতম আসামি হিরক পলাতক রয়েছে। এই মামলার অন্যান্য আসামির সঙ্গে খুলনার সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তাঁর পক্ষে খুলনায় গিয়ে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব নয়। এরই প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি কেন যশোরে ফিরিয়ে দেয়া হবে তার জন্য সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করে। বর্তমান মামলাটি সে অবস্থাতেই রয়েছে। মামলার এক আসামি খুলনার ওয়ার্ড কমিশনার আসাদুজ্জামান লিটু র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। অপর আসামি কোটচাঁদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন কালু ২ বছর আগে স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন। অন্য আসামিরা জামিনে রয়েছে। কেবল ভাইয়ের মেয়ে সেজুঁতি ও প্রণতি চিরদিনের জন্য বাবার স্নেহ ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। স্বামী হারানোর বেদনায় আজও কেঁদে ওঠেন লাকী ভাবি (কেবল ভাইয়ের স্ত্রী)। তিনি জানালেন প্রণতি বেড়ে উঠছে তার ‘ছবি বাবা’কে (কেবল ভাইয়ের ছবি দেখে)দেখে।
বাংলাদেশে ন্যায় বিচার, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার এই বেহাল অবস্থা। অথচ গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বত্তায়ন বাংলাদেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থার উপরই চরম এক আঘাত। প্রকৃত এবং বাস্তবিক অর্থেই গণতন্ত্রের চর্চা ছাড়া এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। দুর্নীতি, অশিক্ষা আর দারিদ্রতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলেই কেবল গণতন্ত্রের পথ মসৃণ হতে পারে। সেই পথ দেখানোর দায়িত্বটা কিন্তু রাজনীতিবিদদেরই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সকল সাংবাদিক, রাজনৈতিক হত্যা-নির্যাতনের বিচার চাই আমরা। আইনমাফিক সকল ধরণের প্রভাবমুক্ত ন্যায্য বিচার।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপি-জামায়াত আমলে ১৪ সাংবাদিক হত্যাকান্ডের তথ্য তুলে ধরেন। এই তথ্য যেমন সত্য তেমনি মহাজোট সরকারের আমলে ৫ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, এটাও সত্য। কিন্তু তিনি (প্রধানমন্ত্রী) অর্ধাংশ স্বীকার করে অর্ধেকটা অস্বীকার করেছেন পরোক্ষভাবে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে জনপ্রিয় একুশে টেলিভিশন বন্ধ করা হয়েছিল। এটা যেমন সত্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভি ও আমার দেশ বন্ধ হলো। উভয়ই সত্য। আমরা অর্ধসত্য নয় পুরো সত্য জানতে চাই। বাংলাদেশের অর্ধসত্য রাজনৈতিক অবস্থান পুরো সত্যের জায়গায় আসতে পারবে কী?

লিংক