পৃষ্ঠাসমূহ

আওয়ামীলীগ ও বিএনপি মধ্যে কি কোনো ভিন্নতা আছে?

আব্দুল মান্নান

আওয়ামীলীগ এবং বিএনপিকে যদি কেউ সমর্থন নাও করে, তাহলেও তাকে এই কথা স্বীকার করতেই হবে দুই দলের ছত্র ছায়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। ফলে দুই দলের নীতি ও আদর্শ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের নীতি ও আদর্শ সম্বন্ধে একটা ধারণা লাভ করা যাবে। মূলতঃ জনগণের নীতি নৈতিকতা বা আদর্শ নিয়ে আলোচনা করা আজকের লিখার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। বরং বৃহৎ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের নীতি ও আদর্শই হবে আজকের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু।

কোন ব্যক্তি, দল, গোত্র ইত্যাদির সাথে অন্য কোন ব্যক্তি, দল, গোত্রের বেশীর ভাগ বৈশিষ্ট্যের মিল দেখা গেলে বেচারা মুদ্রাকে আমরা টেনে আনি। কোন মুদ্রার দুই পিঠে দুই রকম ছবি দেখলেও মুদ্রাটি কিন্তু একটা অবিভাজ্য বস্তু। দুই রকম ছবি দেখে আমরা বিভ্রান্ত হলেও হতে পারি। কিন্তু মুদ্রা এবং ছবি একই ধাতু থেকে তৈরি হওয়ার কারণে দুই ছবির মধ্যে নাড়ীর মিল থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কাজেই এ লিখাতে বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রমাণ করার চেষ্টা থাকবে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির নাড়ী একটাই।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে প্রথম দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে পরিচয় দেয়ার লক্ষ্যে দলটি পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘আওয়ামীলীগ’ নাম ধারণ করে। আওয়ামীলীগের জন্ম পাকিস্তান আমলে হলেও দ্বিতীয় দলটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামীলীগের বড় ভূমিকা ছিল যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যার ফলে আওয়ামীলীগের নেতা ও কর্মীরা বলে থাকেন তাঁরা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। বিএনপির জন্ম যেহেতু স্বাধীনতার পর সেহেতু দল হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ তাদের ছিলনা। তবে এ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা এ দলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছেলেন। তাছাড়াও ত্রিশ শতাংশের বেশী সমর্থক আছে যা প্রধানত আওয়ামীলীগ থেকেই আসা। সে হিসাবে এ দলের নেতৃবৃন্দরাও দাবি করে থাকেন তাঁরাও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আবার এটাও সত্য কথিত স্বাধীনতার বিপক্ষের কিছু লোক উভয় দলেও আছে।

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য আওয়ামীলীগের আন্দোলন দীর্ঘ দিনের। তদানীন্তন পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরে আনার ব্যাপারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে তারা ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। অপর পক্ষে বিএনপির আত্মপ্রকাশ ঘটে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে এবং তা হয়েছিলে একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সে জন্যে বলা হয়ে থাকে বিএনপি হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া একটি দল। কিন্তু ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় আমরা এও দেখেছি কিভাবে একটি দল গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে অগণতান্ত্রিক হয় এবং অগণতান্ত্রিক খোলস পরিবর্তন করে কিভাবে গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়।

আওয়ামীলীগের অবিসংবাদিত নেতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ মরহুম শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এবং চারটি সংবাদ পত্র ছাড়া অন্যগুলিকে বন্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্রের গলা কিভাবে চেপে ধরেছিল তাও ইতিহাসে আছে। পক্ষান্তরে অগণতান্ত্রিক সরকারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৬ সালে পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (PPR) আওতায় রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিয়ে গণতন্ত্রের ধারা ফিরে এনেছিলেন তাও আমাদের জানা। ১৯৮৬ সালে সামরিক ও স্বৈর শাসক জেনারেল এরশাদকে সার্বিকভাবে সহযোগীতা করেছিল আওয়ামীলীগ। ২০০৮ সালে সামরিক শক্তির বলয়ে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্লজ্জ ভাবে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আওয়ামীলীগ তাতো চোখের সামনেই রয়েছে। স্বার্থ হাসিলের জন্য উভয় দলই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করেছিল সেটাও লিখা রয়েছে। উল্লেখ্য বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া একটি দল হলেও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পর আর অগণতান্ত্রিক পথে পা বাড়াইনি। কিন্তু আওয়ামীলীগ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তা করেছে বার বার।

আওয়ামীলীগ শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন এবং বিএনপি জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত। উভয় দলের নেতৃবৃন্দ জনগণের স্বপ্ন নিয়ে ভাবেননা। দল দুটি সাংঘাতিক ভাবে জড়িয়ে পড়েছে পারিবারতন্ত্রে। উভয় দলে বাঘা বাঘা নেতা থাকার পরেও পরিবারের প্রভাব এতটাই প্রবল যে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া অথবা উভয় পরিবারের কোন সদস্য ছাড়া অন্য কারো পক্ষে দলের প্রধান হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। উভয় দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা নেই।

ডান ও বামের সুন্দর সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে দুই দলের নেতৃত্ব। এক সময় যাঁরা বাম ঘরানার তুখোড় নেতা ছিলেন তাঁরা এখন তাঁদের আদর্শকে মিছে-মিছি জলাঞ্জলি দিয়ে দুই নেত্রীর আঁচলের ছায়া মাড়ানোর চেষ্টা করছেন। দুই দলের প্রতিষ্ঠাতাগণ চিন্তা-চেতনায় ছিলেন ডান ঘরানার। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা এতটাই করুণ যে বামের ঠেলায় স্ব স্ব দলের মূল চেতনাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। বামদের সুন্দর যুক্তিও প্রণিধানযোগ্য। এত লম্বা সময় ধরে দলে থাকার পরেও তারা কিভাবে বাম থাকে। কিন্তু তাঁরা কৌশলে তাঁদের আদর্শের অনেক কিছুই ঢুকিয়ে দিচ্ছে জাতীয় বিভিন্ন নীতিমালার মধ্যে। জ্বলন্ত প্রমাণ শিক্ষানীতি ও নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১। অন্যদিকে বিএনপির আমলে ধর্মীয় মূলবোধের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধা প্রদান ছিল বামদের একই ধরনের খেলা।

আওয়ামীলীগ ঢাক-ঢোল পিটে প্রচার করে দলটি সেক্যুলারেজমের ধারক ও বাহক। পক্ষান্তরে বিএনপি সেক্যুলার দল হলেও দেশের মানুষকে বোকা বানানোর জন্যে ঘুরে-ফিরে কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করে তারা ধর্মীয় মূলবোধে বিশ্বাসী। আওয়ামীলীগ সেক্যুলারেজমের আদর্শ ধারন করতে যে অক্ষম তা সংবিধান সংশোধন করতে গিয়ে তাদের নীতিগত অবস্থানের দোদুল্যমানতা তার প্রমাণ বহন করে। অপর দিকে বিএনপি ক্ষমতায় থেকে অথবা বাইরে থেকেও ধর্মীয় মূলবোধ রক্ষার্থে কিছুই করেনি। বিসমিল্লাহ্, আল্লাহর উপর আস্থা এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে উভয় দলের মধ্যে চমৎকার মিল রয়েছে।

এক দল বাঙ্গালী এবং অন্য দল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী বলি আর কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী আইন প্রণয়ন করবোনা বলি, জাতীয়তাবাদী হিসাবে দাবি করলে ধর্মীয় মূল্যবোধে এবং কুরআন-সুন্নাহর উপস্থাপিত চেতনার সাথে তা হবে সাংঘর্ষিক। কুরআন-সুন্নাহ্ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মত দেয়। কুরআনের আহবান পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য।

উভয় দলই ধর্মের নয়, ধর্মের নামে রাজনীতি করে। নির্বাচনের আগে কিছু কিছু তথাকথিত আলেমদেরকে সাথে রাখা এবং ইসলামী দলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, কোন পীরের মাজার থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা, রাজনীতিকগণের দোয়ার জন্য মাথায় টুপি দেয়া ইত্যাদি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানো ছাড়া আর কিছুই না। দুই দলের লোক দেখানো ধর্মপ্রীতির ব্যাপারে আরো উদাহরণ দেয়া যাবে। রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগানোই হচ্ছে ধর্মের নামে রাজনীতি এবং উভয় দলই একাজে পারদর্শী।

আপাতদৃষ্টিতে বিএনপিকে ভারত বিরোধী মনে হলেও অতীতে দেশ পরিচালনার সময় ভারত তোষণ নীতি কারোর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেনা। আর এ ব্যাপারে আওয়ামীলীগের কথা না বলাই ভাল।

উরোক্ত বিষয়গুলি দিকে খেয়াল রাখলে যে কোন মানুষ সহজেই অনুমান করতে পারবে দল দুটির মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু একটাই আর তা হলো ক্ষমতার লড়াইয়ে দুই দল দুই মেরুতে অবস্থান নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করা।

দেশের অধিকাংশ মানুষের দুই দলের প্রতি সমর্থন থাকলেও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, একথা স্বীকার করতেই হবে দুই দলের মাধ্যমে দেশে গুণগত কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বিগত চল্লিশ বছরের কর্ম কান্ডই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যাদের নির্দিষ্ট কোন আদর্শ নেই তাদের কাছে ভাল কিছু আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না। তাই সময় এসেছে দেশের স্বার্থে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের সন্ধানে নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক দল বেছে নেয়ার।