পৃষ্ঠাসমূহ

মৌলবাদীদের পর্দাপ্রথা, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি; আওয়ামীলীগ কি সব ভুলে গেলো?

জঙ্গি নিধন, নারী স্বাধিনতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বিচার বর্হিঃভূত হত্যা বন্ধ এবং সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় আছে। তাই স্বাভাবিত ভাবে দলটির উপর সবার নজর ছিল। আওয়ামী লীগ এর অবস্থা দেখলে মনে হয় তারা এখন নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত বেশী। বাংলাদেশের জনগনের আশা ছিল যে, নতুন সরকার তার মহাজোট ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সম্পুর্ণ ভিন্ন চিত্র। রাজনৈতিক নির্যাতন নিপীড়ন, মানবাধিকার লংঘন, জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার নির্যাতন ও হয়রানীর মধ্য দিয়ে এই সরকার স্বৈরাচার সরকারে রূপ নিচ্ছে।
ভোটের রাজনীতির কারণে তারা বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছে। তার মধ্যে নারী নীতি ও সংবিধানকে ধর্ম নিরপেক্ষ করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য কিছু মোল্লাগোষ্টির প্রতিবাদের মুখে তারা সিডও (CEDAW) সনদে স্বাক্ষর করতে ভয় পাচ্ছে। সরকার ভয় পাচ্ছে আগামী নির্বাচনে যদি এই কারণে ইসলামী গোষ্টির সমর্থন না পায় সেই বিষয়টি নিয়ে। অথচ একটি বার ভাবছে না যে এই সকল প্রতিশ্রুতি দেখেই মানুষ তাদের নির্বাচিত করেছে। সরকার সংবিধানকে ধর্ম নিরপেক্ষ করার কথা বললেও এখন চাচ্ছে ধর্ম এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার মাঝে একটা সমন্বয় করতে। যা প্রকারন্তরে হাস্যকর এবং সংবিধান অবমাননার সামিল।
আমরা যদি সরকারের এই নীতিটাকে কোরান-সুন্নাহ ও বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে ব্যাখ্যা করে দেখি তাহলে পরিস্কার বুঝা যাবে। সিডও (CEDAW) সনদ বাস্তবায়ন কি কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সম্ভব? সিডও (CEDAW) সনদ মানেই হচ্ছে নারীর প্রতি যেকোন প্রকার বৈষম্য বিলোপ। কোরআন-সুন্নাহ কি এই বৈষম্য বিলোপের বিপক্ষে? মোটেও না, কখনো না। উল্টো কোরআন নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যকে সমর্থন করে এবং নারীকে পুরুষের অধীনস্ত মনে করে। সুতরাং সিডও (CEDAW) সনদ আর কোরআন-সুন্নাহ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর।

তাছাড়া আমাদের সংবিধানের সাথে কি কোরআন-সুন্নাহর বিরোধ নেই? সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১), ২৯(২) অনুচ্ছেদগুলোতে সরাসরি নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ব্যাপারে বলা আছে, সেখানে কোরআন কি মনে করে? কোরআনের চোখে নারী পুরুষের সমকক্ষ নয়। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের দ্বিগুন পাবে, ১ জন পুরুষ সাক্ষ্য = ২ নারী সাক্ষ্য, স্বামী স্ত্রীকে প্রহার করতে পারে ইত্যাদি। এ সবই সংবিধানের উপরের ধারাগুলোর [২৭, ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১), ২৯(২)] বিপরীত। যদিও, উত্তরাধিকার আইন থেকে শুরু করে সংবিধান সমর্থিত অনেক আইনেই কোরআন-সুন্নাহকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে- যা আবার সংবিধানের উপরের ধারাগুলোর বিপরীত, সুতরাং- বলা যায় সংবিধান নিজেই স্ববিরোধিতায় ভরপুর। আমাদের সংবিধানে যেমন কোরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় আছে, তেমনি পরিপূরক বিষয়াদিও আছে। সংবিধান রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা বলে, বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয়, সংবিধান পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন, মুসলিম বিবাহ আইনকে সমর্থন করে। আবার উল্টোদিকে- উপরিউক্ত ধারাগুলো যেমন আছে, তেমনি আমাদের সংবিধান সাক্ষ্য আইন ১৯৭২ কে, চুক্তি আইন ১৯৭২ কে সমর্থন করে। এই আইনের বলে- আদালতে ও নির্বাচনে, চুক্তি সম্পাদনে নারী পুরুষের সমান মর্যাদা পায়। যা সরাসরি কোরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে স্ত্রীকে প্রহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যদিও কোরআনে স্ত্রীকে প্রহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, সংবিধান এবং কোরান ও সুন্নাহ পরস্পর সাংঘর্ষিক। একটাকে রেখে আরেকটার পালন অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কের এবং আইনের পরিপন্থি। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সরকার সেই আইন পরিপন্থি কাজে লিপ্ত রয়েছে।
অথচ সরকার সেই দিকে কোনো নজর না দিয়ে উল্টো ব্যস্ত রয়েছে তাদের প্রতিশোধ গ্রহণে। মামলা, হামলা, গ্রেফতার ও সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক নির্যাতন, খুন, গুম, ডাকাতি ও রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিত্যদিনকার ঘটনা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির ঘটনায় অতিষ্ঠ মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকার করলেও তা অব্যাহতভাবে চলেছে। নতুন যোগ হয় সাদা পোশাকে অপহরণ, গুপ্ত হত্যা। বখাটেদের নারী উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ইভটিজিং বা নারী নির্যাতনের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে ফাঁসির আসামি, হত্যা মামলার আসামিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলাকারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় হতবাক হয়েছেন সমাজের বিবেকবান মানুষ । বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে দেশে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, ডাবল ও ট্রিপল মার্ডার, গলাকেটে নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি সাংবাদিকরা। এ সময়ে ৪ লেখক সাংবাদিক নিহত, ১৭০ সাংবাদিক আহত, ৫০ জন লাঞ্ছিত ও ৫৫ জন হুমকির সম্মুখীন হন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ১৭ জনের ওপর হামলা, দু’জনকে গ্রেফতার, একজন অপহৃত ও ১৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২৮১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকার, রাজনৈতিক সহিংসতায় খুন ৪৭০, বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৭০ জন। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুসারে ২০০৯ এ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল নাজুক।
২০০৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা অব্যাহতভাবে চলছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সভা-সমাবেশ বন্ধে ১৪৪ ধারা জারি, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্যাতন ও গ্রেফতার, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটছে এই সরকারের সময়কালে।
হত্যাসহ ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই বেশি ব্যস্ত। কখনও কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ঘটনায় গ্রেফতার হচ্ছে না ঘাতকরা। হত্যাকাণ্ডের পরও খুনি ও তাদের সহযোগীরা মামলার বাদীকেও হত্যার হুমকি দেয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে। খুনিরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় পুলিশও তাদের গ্রেফতার করছে না মর্মে বহু অভিযোগ পুলিশ সদর দফতরে জমা আছে।
একটি গনতান্ত্রিক সরকার জনগনের প্রত্যাশার কোনো মূল্য না দিলে তার ফল যে ভাল হয় না তা নিশ্চয় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভাল ভাবেই জানে।



২০০৯ দৈনিক প্রভাকর।