পৃষ্ঠাসমূহ

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে


কালের খেয়ার ৬৫তম সংখ্যাটির সর্বত্র জুড়ে যেন তারুন্যের পদধ্বনি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছেল। কেননা ওই সংখ্যাটি সম্পাদক সাজিয়েছেন একঝাঁক নতুনের মেলবন্দনে। আর নতুনদের কবিতা ও গল্পগুলো পড়ে এতটা বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে, মনে হচ্ছেল না এরা সবাই তরুণ লিখিয়ে। যা হোক, কালের খেয়া তার প্রতিশ্রুতি রেখেছে এবং আশা করি অহর্নিশ তা রেখে চলবে।
আজকাল অনেকেই 'পাঠকের কলম' বিভাগে লিখে অন্য পাঠকের লেখায় সম্পাদককে মনোরঞ্জন করার বিষয় খুঁজে পান, যেমনটা পেয়েছেন মৌলভীডাঙ্গি, নবাবগঞ্জ, ঢাকার শুভ্র। কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয় 'সুচ ঝাঁজরকে বলছে তোমার তলা ফুটো'_ তাহলে কি অর্থ দাঁড়ায়? ঠিক তেমনটাই করেছেন শুভ্র। তিনি ৬৫তম সংখ্যায় লিখেছেন, 'র্বতমানে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীর মধ্যে কালের খেয়া তার শ্রেষ্ঠত্ব ইতিমধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।' এ কথাটি আমিও নিদির্্বধায় স্বীকার করি কিন্তু শুভ্রর এ কথাটি কি সম্পাদকের মনোরঞ্জন করার মতো কথা নয়? নয় কি স্ববিরোধী? এখন কথা হলো, যদি কেউ কালের খেয়াকে ভালোবেসে অমন একটু-আধটু লিখেই থাকেন তাতে পাঠকের উচিত তা সাধারণভাবে গ্রহণ করা এবং অন্য কিছু খুঁজে বের করার প্রয়াস না চালানো।
অনেকদিন পর কালের খেয়ায় লিটল ম্যাগের আলোচনা দেখতে পেলাম। এজন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। দলীয় ও নামসর্বস্ব সাহিত্যের স্রোতে মেধাবী তরুণদের একমাত্র ভরসা এই লিটল ম্যাগগুলো। আমার জানামতে, গ্রাম ও শহরের আনাচে-কানাচে খ্যাত ও অখ্যাত লিটল ম্যাগগুলোতে তরুণ লেখকরা কাব্যচর্চার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য সাধনাকে টিকিয়ে রেখেছেন।
যা হোক, কালের খেয়া যে নতুনদের বাংলা সাহিত্যের আসনে স্থান করে দিতে বদ্ধপরিকর এ সম্পর্কে অবশিষ্ঠ শঙ্কাটুকুও মুছে দিয়েছেন সম্পাদক তার সুন্দর সম্পাদকীয়তে। এজন্য তাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কালের খেয়া সমকালীন সাহিত্যে প্রতিভূ হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক লাখ লাখ পাঠকের পাললিক অন্তরে, এ কামনা আমার এবং আমাদের।
সুমন আহ্ধসঢ়;মেদ
ওয়ারী, ঢাকা
চাবি : সুলিখিত নয়৮ সেপ্টেম্বর কালের খেয়ায় নিরমিন শিমেলের 'চাবি' গল্পটি পড়ে বিরক্ত হয়ে অভিমত লিখতে চেয়েছিলাম। ২৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ফয়েজ ইসলাম তিতাসের প্রতিক্রিয়ায় গল্পটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করায় বিস্টি্মত হলাম। যেখানে এ ধরনের নিতান্ত সাদামাটা ও অসঙ্গতিপূর্ণ গল্প ছাপানোতে কালের খেয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছি, সেখানে একজন পাঠক গল্পটির ভূয়সী প্রশংসা কিভাবে করলেন ভেবে পাইনি। চিন্তা-চেতনায় এতটা পার্থক্য হওয়ার কথা নয়।
লোহার মতো শক্ত সাবানে গাঁথা গাড়ির চাবিটি তৃতীয়বার ঠুন করার পর শব্দ শুনে কাজের মেয়েটি তার সন্ধান পায়। তার আগে চোখে পড়েনি। একটি সাবানের মধ্যে চাবি রেখে দেখুন কত জোরে শব্দ হয়। কাপড়ের গিট খুলে চাবি নিয়ে কোনো শিশু ছাদে খেলবে, তাও আবার পাওয়া যাবে ছাদের কোণে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পত্রিকায় ছাপা হলো আর রাস্তায় পাঠকের কাছ থেকে পত্রিকা কেড়ে নিয়ে স্বল্প শিক্ষিতা মেয়েটি পত্রিকা পড়ে কামালের কীর্তি জানবে_ বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হয়নি। হোটেল ভাড়া বাকি পড়াতে ওর তো দালালের খপ্টপ্পরে পড়ার কথা। হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া এত সোজা? মেয়েটি বাসা থেকে পালানোর সময়ও গৃহকর্তা অন্যত্র বাসা ভাড়া নিশ্চিত করেননি। স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্যত্র বাসা ভাড়া করে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এরপরও যেহেতু গৃহকর্তা ও কর্ত্রী খারাপ মানুষ ছিলেন না সেহেতু অন্য আত্নীয়-স্বজনের জন্য হলেও বাড়িওয়ালা বা নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে যেতেন। এ ধরনের অসঙ্গতির অভাব নেই।
গল্পটির র্বণনা একেবারেই সরল। নজিবর রহমানদের লেখার মতো। মেয়েটি যখন কামালের সঙ্গে দেখা করে তখনই মনে হয়েছিল চাবিটি হাতছাড়া হয়ে কামালের কাছে চলে যাবে। বাসা পরির্বতনের ইঙ্গিত থেকে আশঙ্কা হয়েছিল লেখক মেয়েটিকে সর্বশ্বান্ত করে বাসায় ফিরিয়ে আনবে। বাসায় ফিরে দেখবে কেউ নেই, যা যৌক্তিক মনে হয়নি। কানা ছেলেকে পদ্মলোচন হিসেবে তিতাস সাহেব দাবি করেছেন, কারণটা একেবারেই বোধগম্য নয়।
মুজিব রহমান
শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ, বিক্রমপুরঅপাঠকের রবীন্দ্রভক্তির জবাবেকালের খেয়ায় রবীন্দ্র বিতর্ককে বধর্িত করার জন্য এ লেখা নয়। একজন অপাঠকের অযাচিতভাবে রবীন্দ্র-বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার দুঃসাহস দেখে চমকে গিয়েই এ লেখা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কালের খেয়ায় চলতি বিতর্ক মূলত রবীন্দ্র বিতর্ক নয়, 'রবীন্দ্র মৌলবাদী', 'রবীন্দ্র বিবেষী' বা 'রবীন্দ্র মূর্খ'দের যথেচ্ছাচার মাত্র।
তার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-উত্তর সব কবির কবিত্বকে খাটো করা। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতা সম্পর্কেও নূ্যনতম জ্ঞান নেই বলেই তিনি এমনটি করেছেন। তার মতে, প্রকৃত কবি জীবন দেবতার নিদরাউশে কবিতা রচনা করেন। তাই রবীন্দ্রনাথই প্রকৃত কবি এবং একমাত্র কবি। তিরিশ-উত্তর কবিরা জীবন দেবতার নিদরাউশ পাননি বলে তারা প্রকৃত কবি নন। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ 'ঈশ্বর নিদরাউশিত সার্বজনীন কবি' আর তার পরের কবিরা 'মানুষের নির্বাচিত স্বল্প পরিসরের কবি'। তার এ বক্তব্যে রবীন্দ্র-উত্তর কবিদের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রকাশ্য বিরোধের গন্দ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি বলতে চান ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথকে কবি বানিয়ে তারপর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, জন্মের পর রবীন্দ্রনাথ কবিত্ব অর্জন করেননি।
তিরিশ-উত্তর কবিতার নতুন বাঁককে স্বীকার করেই তিনি বলেছেন, 'অন্তরের অদৃশ্য কোনো প্রেরণা ছাড়াই আমাদের তিরিশ-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের চেষ্ঠা করলেন।' আমার প্রশ্ন, অন্তরের অদৃশ্য প্রেরণা বা কবিত্বশক্তি ছাড়া তিরিশ-উত্তর কবিরা কিভাবে কবিতা লিখলেন এবং নতুন বাঁকের সৃষ্টি করলেন? তিনি আরো ভুল করেছেন এই ভেবে যে, তিরিশের কবিরা নতুন বাঁকের সৃষ্টি করেছেন 'যতটুকু সময়ের প্রয়োজনে তারও বেশি রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশায়।' কিন্তু এ কথা সর্বজনবিদিত যে, তিরিশের নতুন বাঁক যতটুকু রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশায় তারও বেশি সময়ের প্রয়োজনে, কারণ সময়ের প্রয়োজন ব্যতিত কবিতায় কোনো নতুন বাঁক নির্মাণ সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশাও ছিল সময়েরই অনিবার্য প্রয়োজন।
পত্র লেখকের ধারণা, রবীন্দ্র-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে আত্নস্থ করেননি। তার অবগতির জন্য উল্লেখ করছি জীবনানন্দ দাশের কয়েক লাইন 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা, সাহিত্য, জীবনদর্শন ও সময়ের ভেতর দিয়ে সময়ান্তরের গরিমার দিকে অগ্রসর হবার পথ যেরকম নিরঙ্কুশভাবে গঠন করে গেছেন পৃথিবীর আদিমকালের মহাকবি ও মহাসাধুরাই তা পারতেন; ইদানীং বহু যুগ ধরে পৃথিবীর কোনো দেশই এ রকম লোক-উত্তর পুরুষকে ধারণা করেনি।' এরপর তিনি কী করে বলেন, তিরিশ-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে 'বাদ দিতে' চেয়েছিলেন? তিনি আরো মনে করেন, তিরিশের কবিরা শুধু রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার জন্যই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, 'আমরা মনস্বী অগ্রজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব এ রকম একটা পরামর্শ এঁটে নতুন কবিরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না।'
শুনে বিস্টি্মত হলাম, আজ পর্যন্ত রবীন্দ্র-উত্তর কোনো কবিই নাকি রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বীকার করেননি, তাই তিনি অনাগতকালের কোনো এক কবির অপেক্ষায় দিন গুণছেন, যিনি প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বীকার করবেন এবং সে কারণেই বড় কবি হতে পারবেন। তিনি 'জোর দিয়ে' বলেছেন, 'র্বতমানে কবিতার স্থান মানুষের অন্তরে আগের মতো নেই', কারণ কবিতা 'অন্তরের নিঃসঙ্গ জগতে বিচরণ বাদ দিয়ে নেমে এলো জনমুখরিত পৃথিবীর কোলাহলে।' এ বক্তব্য কতটা হাস্যকর তা পাঠকমাত্রই বুঝবেন। তার প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, রবীন্দ্র-উত্তর কবিতা 'মানুষের কথা, মানুষের জীবনাচরণ, মানুষের দুঃখ-কষ্ঠ, বঞ্চনা-নিপীড়ন, যন্ত্রণা, সংগ্রাম আর প্রতিবাদের ভাষা'। কাজেই তিনি যে মধ্যযুগেই বসবাস করছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রভক্ত হতে গিয়ে যিনি রবীন্দ্র-উত্তর সব কবিদের কৃতিত্বকে খর্ব করলেন এবং বললেন, 'রবীন্দ্রনাথ সব বিতর্কের ঊধের্্ব' তিনি কি প্রথমসারির রবীন্দ্র মৌলবাদী নন?
মেহেদী হাসান অপুর ধৃষ্ঠতা দেখে অবাক হতে হয়। সাহিত্যের পাঠক না হয়ে তিনি কেন যে পাঠকের কলমে লিখে পাঠক হওয়ার মূল্যবান সময় নষ্ঠ করলেন! তিনি হয়তো জানেন না নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে পাঠকের কলমকে আরো জমজমাট করার জন্যই সম্পাদক মাঝে মধ্যে তার মতো অযোগ্য লোকের লেখা ছাপেন, যাতে প্রকৃত সত্যটা তারা জানতে পারেন, বুঝতে পারেন নিজেদের কলমের দুর্বলতা।
রাজীব ভট্টাচার্য
পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়াউম্মে মুসলিমার হ য ব র লপত্রিকার বিভিন্ন সাময়িকীর সুবাদে উম্মে মুসলিমার লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কালের খেয়ায় প্রকাশিত লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছি বিগত দিনে। প্রতিটি লেখা ('ডার্করুম সহকারী', 'অসম' 'সৌদি চুড়ি') পড়ার শেষে বারবারই মনে হয়েছে তার প্রেক্ষিতে কিছু লেখি। কিন্তু সেই কাজটি হয়ে উঠেনি মূলত অলসতার কারণে। যাই হোক, এবার ৬৪-তম সংখ্যায় তার লেখা গল্প 'জেবুল্পিম্নসা' পড়ে মনে হলো সতি্যই কিছু লেখা দরকার।
জেবুল্পিম্নসা গল্পের শুরু এভাবে, 'আরতি রানী দত্ত ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপর বাড়ি থেকে উধাও।' অর্থাৎ গল্পের শুরুতে পাঠকদের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, আরতি যখন পরীক্ষা দেয় তখন দেশে ম্যাট্রিক (ম্যাট্রিকুলেশন; এসএসসি নয়) ধারণা প্রচলিত। তার মানে ঘটনার সময়কাল নিদরাউশ। তবে আরো একটি জায়গায় সময়কালের ধারণা পাওয়া যায়। গল্পের চরিত্র সাবু (সাবদু্দিন) সম্পর্কে লেখক বলেন, 'রামচন্দ্রপুরে ও রকম নায়করাজরাজ্জাক কাটিং (রাজ্জাক কাটিং?) চেহারা আর ক'জনের আছে?' সুতরাং এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি গল্পের সময়কাল সত্তর থেকে আশি দশকের মাঝামাঝি। তখন অনেক তরুণই নায়ক রাজ্জাক ্টারা প্রভাবিত হতেন। সেই সময়ের একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আরতি এবং আপাদমস্তক মুসলিম পরিবারের ছেলে সাবুর সংক্ষিপ্ত প্রেমকে কেন্দ্র করে গল্পের ব্যাপ্তি। আর সেই আরতির র্বণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, 'মুখখানা যেন ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো (ঠিক বুঝলাম না 'সরস্বতী ঠাকুর' কথাটার মানে কি?)। সেই আরতি প্রতিদিন সাবুর দোকানের সামনে দিয়ে স্কুলে যায়। গল্পকার দু'জনের মধ্যে প্রেম বোঝাতে শুধু ইঙ্গিত করেছেন, 'সাবুর দিকে আরতি একবার তাকাবে, সাবু তাতে নিশ্চিত ছিল।' এছাড়া যেহেতু প্রেম কি করে হলো তার আর কোনো ইঙ্গিত নেই, তাই ধরে নিতে পারি লেখক আমাদেরও বলছেন যে, এদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে আপনারা নিশ্চিত থাকুন। গল্প থেকে আরো জানা যায় সেই সময়ের একটি মফস্বল এলাকার গঞ্জে আরতির জ্যাঠাত ভাইয়ের দোকানে এবং সাবুর দোকানে টেলিফোন রয়েছে! সেই টেলিফোনের সাহায্যেয ঝ্যাঠাত ভাই দোকান থেকে খেতে গেলে আরতি সাবুর সঙ্গে ফোনে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। অর্থাৎ সেই সত্তর-আশি দশকে ফোনালাপে প্রেম! তবুও লেখককে ধন্যবাদ, তিনি চরিত্রগুলোর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেননি! সেই ফোনালাপে আরতি এতই মগ্ন হয় যে, ইসলামী নিয়মকানুন শেখার জন্য বাজার থেকে নিজেই 'সহজ নামাজ শিক্ষা' কিনে আনে! প্রেমাসক্ত আরতি নিজেকে প্রস্থুত করতে থাকে ইসলামের জন্য! অবশ্য লেখক এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, 'আরতিরও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কোনো আপত্তি নেই।' সাবুরা এলাকায় প্রভাবশালী। অবস্থাসম্পন্ন মিয়া বাড়ির দরাজ মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র সে। তার পিতা আবার মসজিদের ইমাম। আর সেই ইমামের ছেলে সাবু ভাগিয়ে নিয়ে আসে আরতিকে নিজের বাড়ি। এদিকে আবার হারিয়ে যাওয়া আরতিকে দু'দিনেও খুঁজে পায় না তার পরিবার। পরে আরতির মা মেয়ের বালিশের নিচে থেকে নামাজ শিক্ষা এনে তার ভাশুরের ছেলেদের দেখান (আরতির বাবার কোনো উল্লেখ নেই) তা দেখে জ্যাঠাত দাদা লক্ষণ যৌতুকে পাওয়া হ্যান্ড্রেড টেন (হান্ড্রেড টেন! রাজ্জাকের সময়কালে!) মোটরবাইক চালিয়ে সাবুর বাড়ি খুঁজতে আসে। আমরা লক্ষ্য করি যে, গল্পে আরতির দাদা হ্যান্ড্রেড টেন মোটরসাইকেল চালায়, দোকানে টেলিফোনও আছে। অপরদিকে সাবুর বাবা চলাচল করেন ছইওয়ালা মহিষের গাড়ি দিয়ে। এসবের প্রেক্ষিতে আসলে কে যে অবস্থাসম্পন্ন, প্রশ্ন জাগে? তারপরও লেখক যেহেতু বলেছেন সাবুর বাবা অবস্থাসম্পন্ন অতএব, সাবুর বাবাই অবস্থাসম্পন্ন। সে অবস্থাসম্পন্ন; কড়া ইমাম (গল্পে উল্লেখ আছে, দরাজ মিয়ার কড়া নিদরাউশ, তার জীবদ্দশায় কেউ আলাদা হতে পারবে না)। পিতার কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দু মেয়েকে বউ করার জন্য নিয়ে আসায় তিনি খুবই পুলকিত! তার পুলকের র্বণনা পাওয়া যায় আরতিকে খুঁজতে আসা জ্যাঠাত ভাইয়ের সঙ্গে কথোপকথনে। তিনি তাকে সাবুর বন্দু ভেবে বলেন, 'ও, সাবুর ইয়ার বুঝি আপনি? এত দেরি করলেন আসতে? আজ তো আবার আমার সাবুর বৌভাত। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি তসরিফ রাখুন। হাতে-মুখে পানি দেন। আমি আগে খানার ব্যবস্থা করি।' পরে যখন তিনি আরতির জ্যাঠাত ভাইকে চিনতে পারেন, তখন সাবুকে উদ্দেশ করে বলেন, 'তোর বড় কুটুম বুঝি? আরে আপনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত মেহমান।... সাবু তুই আমার জেবুল্পিম্নসা মাকে নিয়ে আয়' অর্থাৎ এই ফাঁকে বিয়ে হয়েছে। আরতির নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে জেবুল্পিম্নসা। সেই জেবুল্পিম্নসা কি সাবলীলভাবে তার জ্যাঠাত ভাইয়ের সামনে এসে বলে, 'মা-বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করবে। আমি খুব ভালো আছি।' এই তার পরিবারের সঙ্গে শেষ আলাপ। পরর্বতী অংশে চলে জেবুল্পিম্নসা ওরফে আরতির মুসলিম রীতি-নীতি আত্নস্থ করার পালা।
সাবুর বাবার উদারতা মুগ্গব্দ হওয়ার মতো। তবে আমরা তো এই সমাজেরই মানুষ। তাই সমাজের মানুষগুলোর বৈশিষে্ট্যর কথা কম-বেশি সবার জানা আছে। আজ এ একবিংশ শতাব্দীতেও দরাজ মিয়ার মতো উদারপন্থি ইমাম, যে কিনা মহাখুশিতে তার হিন্দু পুত্রবধহৃকে বরণ করে নেয়; চোখে পড়ে না। আর সময়টা যদি হয় সত্তর-আশির দশকের মফস্বল_ তবে তো কথাই নেই। গল্পের আরো কিছু ব্যাপার অবাক করে দেয়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে ঢাক-বাজিয়ে শারদীয় দর্গাউৎসব পালন করে আসছে। কিন্তু তা বাজানো হয় কিছু নির্দিষ্ঠ সময়ে। যেমন ষষ্ঠীতে সন্দ্যার পর ঢাক বাজিয়ে ধহৃপ জ্বালিয়ে পূজা ম-পগুলোতে বোধন সম্পন্ন করা হয়। এ রীতি হয়তো মুসলমান অধু্যষিত এলাকায় রমজান মাসে হলে সময়ের কিছুটা এদিক-সেদিক করে পালন করা হয় কিন্তু কখনোই তা ভোরে চলে যায় না। গল্পকার যখন লেখেন, 'পরদিন ষষ্ঠী। ঠাকুর ভিটেয় উঠবে। ভোরবেলা ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বুকের মধ্যে বদ্যো বেজে উঠল...' তখন বদ্যো আমাদের বুকেও বেজে উঠে আর তা হচ্ছে বিস্ময়ের! আর বিস্ময় নিয়ে ভাবি, একি অন্য রীতির প্রতি লেখকের অবহেলা নাকি অজ্ঞতা? অজ্ঞতাই বা বলি কি করে!
গল্পটা পড়ে কি বোঝা গেল কিংবা কেন লেখা হলো; তার কোনো উত্তর মিলে না। এই গল্পের উদ্দেশ্য কি প্রশ্ন করলে যদি উত্তর হয় জেবুল্পিম্নসা ওরফে আরতির মাধ্যমে রমজান মাস উপলক্ষে পাঠকদের আবারো ইফতারের দোয়া (গল্পে আরতির মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ ইফতারের দোয়া পড়িয়েছেন গল্পকার) মনে করিয়ে দেওয়া, তবে উদ্দেশ্য একেবারে সফল। ধান ভানতে শিবের গীতটা একটু বেশি গাওয়া হলো; এই যা। আর যদি গল্পের শিল্পমূল্যের দাবি ওঠে তবে কিন্তু পাঠক নিরুপায়।
প্রকাশক কিংবা সম্পাদকের অনুরোধে অনেক লেখকই লেখা তৈরি করেন। 'জেবুল্পিম্নসা' গল্প পড়ে মনে হয়েছে যেন লেখককে কেউ বলেছেন, সামনে রোজা এবং পূজা। এ পূজা আর রোজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারকে নিয়ে একটি প্রেম জাতীয় লেখা তৈরি করুন, যা পাবলিক খাবে। আর যেহেতু আপনি মুসলমান এবং মুসলিমপ্রধান দেশ সুতরাং সে ধর্মই যেন প্রাধান্য পায়। এরকম ঘটনা যদি অন্য যে কোনো সাময়িকীর ক্ষেত্রে ঘটত তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কালের খেয়াকে কেন্দ্র করে আরোপিত, ফরমায়েশি লেখক গড়ে উঠুক; এমনটা কখনোই কাম্য নয়।
আমরা যারা পাঠক তারা জানি, গল্পকারকে সমাজ, সময়, সংস্কার ও কাহিনী র্বণনায় সজাগ থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় লেখাটা যেন শুধু শুধু কলমের টানে এগিয়ে না গিয়ে বিবেক-বোধ, যুক্তি ্টারা পরিচালিত হয়। সেসঙ্গে পাঠকের আস্থা ও চাহিদাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনও রয়েছে। আরোপিত কাহিনী পাঠকরা চিরকালই প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে লেখককেও। কিন্তু এমনটি যেন উম্মে মুসলিমার ক্ষেত্রে না ঘটে। কারণ এই গল্পকারের লেখার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে। শুধু ক্ষমতাটা একটু যাচাই করে একটা গল্প তার কাছে যতটুকু সময় দাবি করে সেই অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত। আর একজন পাঠক হিসেবে তার কাছে এটুকু দাবি নিশ্চয়ই করতে পারি?
সুমন আজাদ
শাবিপ্রবি, সিলেট


প্রকাশিত লেখার লিংক