পৃষ্ঠাসমূহ

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে


কালের খেয়ার ৬৫তম সংখ্যাটির সর্বত্র জুড়ে যেন তারুন্যের পদধ্বনি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছেল। কেননা ওই সংখ্যাটি সম্পাদক সাজিয়েছেন একঝাঁক নতুনের মেলবন্দনে। আর নতুনদের কবিতা ও গল্পগুলো পড়ে এতটা বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে, মনে হচ্ছেল না এরা সবাই তরুণ লিখিয়ে। যা হোক, কালের খেয়া তার প্রতিশ্রুতি রেখেছে এবং আশা করি অহর্নিশ তা রেখে চলবে।
আজকাল অনেকেই 'পাঠকের কলম' বিভাগে লিখে অন্য পাঠকের লেখায় সম্পাদককে মনোরঞ্জন করার বিষয় খুঁজে পান, যেমনটা পেয়েছেন মৌলভীডাঙ্গি, নবাবগঞ্জ, ঢাকার শুভ্র। কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয় 'সুচ ঝাঁজরকে বলছে তোমার তলা ফুটো'_ তাহলে কি অর্থ দাঁড়ায়? ঠিক তেমনটাই করেছেন শুভ্র। তিনি ৬৫তম সংখ্যায় লিখেছেন, 'র্বতমানে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীর মধ্যে কালের খেয়া তার শ্রেষ্ঠত্ব ইতিমধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।' এ কথাটি আমিও নিদির্্বধায় স্বীকার করি কিন্তু শুভ্রর এ কথাটি কি সম্পাদকের মনোরঞ্জন করার মতো কথা নয়? নয় কি স্ববিরোধী? এখন কথা হলো, যদি কেউ কালের খেয়াকে ভালোবেসে অমন একটু-আধটু লিখেই থাকেন তাতে পাঠকের উচিত তা সাধারণভাবে গ্রহণ করা এবং অন্য কিছু খুঁজে বের করার প্রয়াস না চালানো।
অনেকদিন পর কালের খেয়ায় লিটল ম্যাগের আলোচনা দেখতে পেলাম। এজন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। দলীয় ও নামসর্বস্ব সাহিত্যের স্রোতে মেধাবী তরুণদের একমাত্র ভরসা এই লিটল ম্যাগগুলো। আমার জানামতে, গ্রাম ও শহরের আনাচে-কানাচে খ্যাত ও অখ্যাত লিটল ম্যাগগুলোতে তরুণ লেখকরা কাব্যচর্চার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য সাধনাকে টিকিয়ে রেখেছেন।
যা হোক, কালের খেয়া যে নতুনদের বাংলা সাহিত্যের আসনে স্থান করে দিতে বদ্ধপরিকর এ সম্পর্কে অবশিষ্ঠ শঙ্কাটুকুও মুছে দিয়েছেন সম্পাদক তার সুন্দর সম্পাদকীয়তে। এজন্য তাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কালের খেয়া সমকালীন সাহিত্যে প্রতিভূ হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক লাখ লাখ পাঠকের পাললিক অন্তরে, এ কামনা আমার এবং আমাদের।
সুমন আহ্ধসঢ়;মেদ
ওয়ারী, ঢাকা
চাবি : সুলিখিত নয়৮ সেপ্টেম্বর কালের খেয়ায় নিরমিন শিমেলের 'চাবি' গল্পটি পড়ে বিরক্ত হয়ে অভিমত লিখতে চেয়েছিলাম। ২৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ফয়েজ ইসলাম তিতাসের প্রতিক্রিয়ায় গল্পটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করায় বিস্টি্মত হলাম। যেখানে এ ধরনের নিতান্ত সাদামাটা ও অসঙ্গতিপূর্ণ গল্প ছাপানোতে কালের খেয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছি, সেখানে একজন পাঠক গল্পটির ভূয়সী প্রশংসা কিভাবে করলেন ভেবে পাইনি। চিন্তা-চেতনায় এতটা পার্থক্য হওয়ার কথা নয়।
লোহার মতো শক্ত সাবানে গাঁথা গাড়ির চাবিটি তৃতীয়বার ঠুন করার পর শব্দ শুনে কাজের মেয়েটি তার সন্ধান পায়। তার আগে চোখে পড়েনি। একটি সাবানের মধ্যে চাবি রেখে দেখুন কত জোরে শব্দ হয়। কাপড়ের গিট খুলে চাবি নিয়ে কোনো শিশু ছাদে খেলবে, তাও আবার পাওয়া যাবে ছাদের কোণে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পত্রিকায় ছাপা হলো আর রাস্তায় পাঠকের কাছ থেকে পত্রিকা কেড়ে নিয়ে স্বল্প শিক্ষিতা মেয়েটি পত্রিকা পড়ে কামালের কীর্তি জানবে_ বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হয়নি। হোটেল ভাড়া বাকি পড়াতে ওর তো দালালের খপ্টপ্পরে পড়ার কথা। হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া এত সোজা? মেয়েটি বাসা থেকে পালানোর সময়ও গৃহকর্তা অন্যত্র বাসা ভাড়া নিশ্চিত করেননি। স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্যত্র বাসা ভাড়া করে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এরপরও যেহেতু গৃহকর্তা ও কর্ত্রী খারাপ মানুষ ছিলেন না সেহেতু অন্য আত্নীয়-স্বজনের জন্য হলেও বাড়িওয়ালা বা নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে যেতেন। এ ধরনের অসঙ্গতির অভাব নেই।
গল্পটির র্বণনা একেবারেই সরল। নজিবর রহমানদের লেখার মতো। মেয়েটি যখন কামালের সঙ্গে দেখা করে তখনই মনে হয়েছিল চাবিটি হাতছাড়া হয়ে কামালের কাছে চলে যাবে। বাসা পরির্বতনের ইঙ্গিত থেকে আশঙ্কা হয়েছিল লেখক মেয়েটিকে সর্বশ্বান্ত করে বাসায় ফিরিয়ে আনবে। বাসায় ফিরে দেখবে কেউ নেই, যা যৌক্তিক মনে হয়নি। কানা ছেলেকে পদ্মলোচন হিসেবে তিতাস সাহেব দাবি করেছেন, কারণটা একেবারেই বোধগম্য নয়।
মুজিব রহমান
শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ, বিক্রমপুরঅপাঠকের রবীন্দ্রভক্তির জবাবেকালের খেয়ায় রবীন্দ্র বিতর্ককে বধর্িত করার জন্য এ লেখা নয়। একজন অপাঠকের অযাচিতভাবে রবীন্দ্র-বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার দুঃসাহস দেখে চমকে গিয়েই এ লেখা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কালের খেয়ায় চলতি বিতর্ক মূলত রবীন্দ্র বিতর্ক নয়, 'রবীন্দ্র মৌলবাদী', 'রবীন্দ্র বিবেষী' বা 'রবীন্দ্র মূর্খ'দের যথেচ্ছাচার মাত্র।
তার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-উত্তর সব কবির কবিত্বকে খাটো করা। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতা সম্পর্কেও নূ্যনতম জ্ঞান নেই বলেই তিনি এমনটি করেছেন। তার মতে, প্রকৃত কবি জীবন দেবতার নিদরাউশে কবিতা রচনা করেন। তাই রবীন্দ্রনাথই প্রকৃত কবি এবং একমাত্র কবি। তিরিশ-উত্তর কবিরা জীবন দেবতার নিদরাউশ পাননি বলে তারা প্রকৃত কবি নন। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ 'ঈশ্বর নিদরাউশিত সার্বজনীন কবি' আর তার পরের কবিরা 'মানুষের নির্বাচিত স্বল্প পরিসরের কবি'। তার এ বক্তব্যে রবীন্দ্র-উত্তর কবিদের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রকাশ্য বিরোধের গন্দ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি বলতে চান ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথকে কবি বানিয়ে তারপর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, জন্মের পর রবীন্দ্রনাথ কবিত্ব অর্জন করেননি।
তিরিশ-উত্তর কবিতার নতুন বাঁককে স্বীকার করেই তিনি বলেছেন, 'অন্তরের অদৃশ্য কোনো প্রেরণা ছাড়াই আমাদের তিরিশ-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের চেষ্ঠা করলেন।' আমার প্রশ্ন, অন্তরের অদৃশ্য প্রেরণা বা কবিত্বশক্তি ছাড়া তিরিশ-উত্তর কবিরা কিভাবে কবিতা লিখলেন এবং নতুন বাঁকের সৃষ্টি করলেন? তিনি আরো ভুল করেছেন এই ভেবে যে, তিরিশের কবিরা নতুন বাঁকের সৃষ্টি করেছেন 'যতটুকু সময়ের প্রয়োজনে তারও বেশি রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশায়।' কিন্তু এ কথা সর্বজনবিদিত যে, তিরিশের নতুন বাঁক যতটুকু রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশায় তারও বেশি সময়ের প্রয়োজনে, কারণ সময়ের প্রয়োজন ব্যতিত কবিতায় কোনো নতুন বাঁক নির্মাণ সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রত্যাশাও ছিল সময়েরই অনিবার্য প্রয়োজন।
পত্র লেখকের ধারণা, রবীন্দ্র-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে আত্নস্থ করেননি। তার অবগতির জন্য উল্লেখ করছি জীবনানন্দ দাশের কয়েক লাইন 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা, সাহিত্য, জীবনদর্শন ও সময়ের ভেতর দিয়ে সময়ান্তরের গরিমার দিকে অগ্রসর হবার পথ যেরকম নিরঙ্কুশভাবে গঠন করে গেছেন পৃথিবীর আদিমকালের মহাকবি ও মহাসাধুরাই তা পারতেন; ইদানীং বহু যুগ ধরে পৃথিবীর কোনো দেশই এ রকম লোক-উত্তর পুরুষকে ধারণা করেনি।' এরপর তিনি কী করে বলেন, তিরিশ-উত্তর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে 'বাদ দিতে' চেয়েছিলেন? তিনি আরো মনে করেন, তিরিশের কবিরা শুধু রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার জন্যই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, 'আমরা মনস্বী অগ্রজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব এ রকম একটা পরামর্শ এঁটে নতুন কবিরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না।'
শুনে বিস্টি্মত হলাম, আজ পর্যন্ত রবীন্দ্র-উত্তর কোনো কবিই নাকি রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বীকার করেননি, তাই তিনি অনাগতকালের কোনো এক কবির অপেক্ষায় দিন গুণছেন, যিনি প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বীকার করবেন এবং সে কারণেই বড় কবি হতে পারবেন। তিনি 'জোর দিয়ে' বলেছেন, 'র্বতমানে কবিতার স্থান মানুষের অন্তরে আগের মতো নেই', কারণ কবিতা 'অন্তরের নিঃসঙ্গ জগতে বিচরণ বাদ দিয়ে নেমে এলো জনমুখরিত পৃথিবীর কোলাহলে।' এ বক্তব্য কতটা হাস্যকর তা পাঠকমাত্রই বুঝবেন। তার প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, রবীন্দ্র-উত্তর কবিতা 'মানুষের কথা, মানুষের জীবনাচরণ, মানুষের দুঃখ-কষ্ঠ, বঞ্চনা-নিপীড়ন, যন্ত্রণা, সংগ্রাম আর প্রতিবাদের ভাষা'। কাজেই তিনি যে মধ্যযুগেই বসবাস করছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রভক্ত হতে গিয়ে যিনি রবীন্দ্র-উত্তর সব কবিদের কৃতিত্বকে খর্ব করলেন এবং বললেন, 'রবীন্দ্রনাথ সব বিতর্কের ঊধের্্ব' তিনি কি প্রথমসারির রবীন্দ্র মৌলবাদী নন?
মেহেদী হাসান অপুর ধৃষ্ঠতা দেখে অবাক হতে হয়। সাহিত্যের পাঠক না হয়ে তিনি কেন যে পাঠকের কলমে লিখে পাঠক হওয়ার মূল্যবান সময় নষ্ঠ করলেন! তিনি হয়তো জানেন না নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে পাঠকের কলমকে আরো জমজমাট করার জন্যই সম্পাদক মাঝে মধ্যে তার মতো অযোগ্য লোকের লেখা ছাপেন, যাতে প্রকৃত সত্যটা তারা জানতে পারেন, বুঝতে পারেন নিজেদের কলমের দুর্বলতা।
রাজীব ভট্টাচার্য
পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়াউম্মে মুসলিমার হ য ব র লপত্রিকার বিভিন্ন সাময়িকীর সুবাদে উম্মে মুসলিমার লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কালের খেয়ায় প্রকাশিত লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছি বিগত দিনে। প্রতিটি লেখা ('ডার্করুম সহকারী', 'অসম' 'সৌদি চুড়ি') পড়ার শেষে বারবারই মনে হয়েছে তার প্রেক্ষিতে কিছু লেখি। কিন্তু সেই কাজটি হয়ে উঠেনি মূলত অলসতার কারণে। যাই হোক, এবার ৬৪-তম সংখ্যায় তার লেখা গল্প 'জেবুল্পিম্নসা' পড়ে মনে হলো সতি্যই কিছু লেখা দরকার।
জেবুল্পিম্নসা গল্পের শুরু এভাবে, 'আরতি রানী দত্ত ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপর বাড়ি থেকে উধাও।' অর্থাৎ গল্পের শুরুতে পাঠকদের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, আরতি যখন পরীক্ষা দেয় তখন দেশে ম্যাট্রিক (ম্যাট্রিকুলেশন; এসএসসি নয়) ধারণা প্রচলিত। তার মানে ঘটনার সময়কাল নিদরাউশ। তবে আরো একটি জায়গায় সময়কালের ধারণা পাওয়া যায়। গল্পের চরিত্র সাবু (সাবদু্দিন) সম্পর্কে লেখক বলেন, 'রামচন্দ্রপুরে ও রকম নায়করাজরাজ্জাক কাটিং (রাজ্জাক কাটিং?) চেহারা আর ক'জনের আছে?' সুতরাং এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি গল্পের সময়কাল সত্তর থেকে আশি দশকের মাঝামাঝি। তখন অনেক তরুণই নায়ক রাজ্জাক ্টারা প্রভাবিত হতেন। সেই সময়ের একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আরতি এবং আপাদমস্তক মুসলিম পরিবারের ছেলে সাবুর সংক্ষিপ্ত প্রেমকে কেন্দ্র করে গল্পের ব্যাপ্তি। আর সেই আরতির র্বণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, 'মুখখানা যেন ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো (ঠিক বুঝলাম না 'সরস্বতী ঠাকুর' কথাটার মানে কি?)। সেই আরতি প্রতিদিন সাবুর দোকানের সামনে দিয়ে স্কুলে যায়। গল্পকার দু'জনের মধ্যে প্রেম বোঝাতে শুধু ইঙ্গিত করেছেন, 'সাবুর দিকে আরতি একবার তাকাবে, সাবু তাতে নিশ্চিত ছিল।' এছাড়া যেহেতু প্রেম কি করে হলো তার আর কোনো ইঙ্গিত নেই, তাই ধরে নিতে পারি লেখক আমাদেরও বলছেন যে, এদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে আপনারা নিশ্চিত থাকুন। গল্প থেকে আরো জানা যায় সেই সময়ের একটি মফস্বল এলাকার গঞ্জে আরতির জ্যাঠাত ভাইয়ের দোকানে এবং সাবুর দোকানে টেলিফোন রয়েছে! সেই টেলিফোনের সাহায্যেয ঝ্যাঠাত ভাই দোকান থেকে খেতে গেলে আরতি সাবুর সঙ্গে ফোনে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। অর্থাৎ সেই সত্তর-আশি দশকে ফোনালাপে প্রেম! তবুও লেখককে ধন্যবাদ, তিনি চরিত্রগুলোর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেননি! সেই ফোনালাপে আরতি এতই মগ্ন হয় যে, ইসলামী নিয়মকানুন শেখার জন্য বাজার থেকে নিজেই 'সহজ নামাজ শিক্ষা' কিনে আনে! প্রেমাসক্ত আরতি নিজেকে প্রস্থুত করতে থাকে ইসলামের জন্য! অবশ্য লেখক এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, 'আরতিরও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কোনো আপত্তি নেই।' সাবুরা এলাকায় প্রভাবশালী। অবস্থাসম্পন্ন মিয়া বাড়ির দরাজ মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র সে। তার পিতা আবার মসজিদের ইমাম। আর সেই ইমামের ছেলে সাবু ভাগিয়ে নিয়ে আসে আরতিকে নিজের বাড়ি। এদিকে আবার হারিয়ে যাওয়া আরতিকে দু'দিনেও খুঁজে পায় না তার পরিবার। পরে আরতির মা মেয়ের বালিশের নিচে থেকে নামাজ শিক্ষা এনে তার ভাশুরের ছেলেদের দেখান (আরতির বাবার কোনো উল্লেখ নেই) তা দেখে জ্যাঠাত দাদা লক্ষণ যৌতুকে পাওয়া হ্যান্ড্রেড টেন (হান্ড্রেড টেন! রাজ্জাকের সময়কালে!) মোটরবাইক চালিয়ে সাবুর বাড়ি খুঁজতে আসে। আমরা লক্ষ্য করি যে, গল্পে আরতির দাদা হ্যান্ড্রেড টেন মোটরসাইকেল চালায়, দোকানে টেলিফোনও আছে। অপরদিকে সাবুর বাবা চলাচল করেন ছইওয়ালা মহিষের গাড়ি দিয়ে। এসবের প্রেক্ষিতে আসলে কে যে অবস্থাসম্পন্ন, প্রশ্ন জাগে? তারপরও লেখক যেহেতু বলেছেন সাবুর বাবা অবস্থাসম্পন্ন অতএব, সাবুর বাবাই অবস্থাসম্পন্ন। সে অবস্থাসম্পন্ন; কড়া ইমাম (গল্পে উল্লেখ আছে, দরাজ মিয়ার কড়া নিদরাউশ, তার জীবদ্দশায় কেউ আলাদা হতে পারবে না)। পিতার কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দু মেয়েকে বউ করার জন্য নিয়ে আসায় তিনি খুবই পুলকিত! তার পুলকের র্বণনা পাওয়া যায় আরতিকে খুঁজতে আসা জ্যাঠাত ভাইয়ের সঙ্গে কথোপকথনে। তিনি তাকে সাবুর বন্দু ভেবে বলেন, 'ও, সাবুর ইয়ার বুঝি আপনি? এত দেরি করলেন আসতে? আজ তো আবার আমার সাবুর বৌভাত। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি তসরিফ রাখুন। হাতে-মুখে পানি দেন। আমি আগে খানার ব্যবস্থা করি।' পরে যখন তিনি আরতির জ্যাঠাত ভাইকে চিনতে পারেন, তখন সাবুকে উদ্দেশ করে বলেন, 'তোর বড় কুটুম বুঝি? আরে আপনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত মেহমান।... সাবু তুই আমার জেবুল্পিম্নসা মাকে নিয়ে আয়' অর্থাৎ এই ফাঁকে বিয়ে হয়েছে। আরতির নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে জেবুল্পিম্নসা। সেই জেবুল্পিম্নসা কি সাবলীলভাবে তার জ্যাঠাত ভাইয়ের সামনে এসে বলে, 'মা-বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করবে। আমি খুব ভালো আছি।' এই তার পরিবারের সঙ্গে শেষ আলাপ। পরর্বতী অংশে চলে জেবুল্পিম্নসা ওরফে আরতির মুসলিম রীতি-নীতি আত্নস্থ করার পালা।
সাবুর বাবার উদারতা মুগ্গব্দ হওয়ার মতো। তবে আমরা তো এই সমাজেরই মানুষ। তাই সমাজের মানুষগুলোর বৈশিষে্ট্যর কথা কম-বেশি সবার জানা আছে। আজ এ একবিংশ শতাব্দীতেও দরাজ মিয়ার মতো উদারপন্থি ইমাম, যে কিনা মহাখুশিতে তার হিন্দু পুত্রবধহৃকে বরণ করে নেয়; চোখে পড়ে না। আর সময়টা যদি হয় সত্তর-আশির দশকের মফস্বল_ তবে তো কথাই নেই। গল্পের আরো কিছু ব্যাপার অবাক করে দেয়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে ঢাক-বাজিয়ে শারদীয় দর্গাউৎসব পালন করে আসছে। কিন্তু তা বাজানো হয় কিছু নির্দিষ্ঠ সময়ে। যেমন ষষ্ঠীতে সন্দ্যার পর ঢাক বাজিয়ে ধহৃপ জ্বালিয়ে পূজা ম-পগুলোতে বোধন সম্পন্ন করা হয়। এ রীতি হয়তো মুসলমান অধু্যষিত এলাকায় রমজান মাসে হলে সময়ের কিছুটা এদিক-সেদিক করে পালন করা হয় কিন্তু কখনোই তা ভোরে চলে যায় না। গল্পকার যখন লেখেন, 'পরদিন ষষ্ঠী। ঠাকুর ভিটেয় উঠবে। ভোরবেলা ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বুকের মধ্যে বদ্যো বেজে উঠল...' তখন বদ্যো আমাদের বুকেও বেজে উঠে আর তা হচ্ছে বিস্ময়ের! আর বিস্ময় নিয়ে ভাবি, একি অন্য রীতির প্রতি লেখকের অবহেলা নাকি অজ্ঞতা? অজ্ঞতাই বা বলি কি করে!
গল্পটা পড়ে কি বোঝা গেল কিংবা কেন লেখা হলো; তার কোনো উত্তর মিলে না। এই গল্পের উদ্দেশ্য কি প্রশ্ন করলে যদি উত্তর হয় জেবুল্পিম্নসা ওরফে আরতির মাধ্যমে রমজান মাস উপলক্ষে পাঠকদের আবারো ইফতারের দোয়া (গল্পে আরতির মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ ইফতারের দোয়া পড়িয়েছেন গল্পকার) মনে করিয়ে দেওয়া, তবে উদ্দেশ্য একেবারে সফল। ধান ভানতে শিবের গীতটা একটু বেশি গাওয়া হলো; এই যা। আর যদি গল্পের শিল্পমূল্যের দাবি ওঠে তবে কিন্তু পাঠক নিরুপায়।
প্রকাশক কিংবা সম্পাদকের অনুরোধে অনেক লেখকই লেখা তৈরি করেন। 'জেবুল্পিম্নসা' গল্প পড়ে মনে হয়েছে যেন লেখককে কেউ বলেছেন, সামনে রোজা এবং পূজা। এ পূজা আর রোজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারকে নিয়ে একটি প্রেম জাতীয় লেখা তৈরি করুন, যা পাবলিক খাবে। আর যেহেতু আপনি মুসলমান এবং মুসলিমপ্রধান দেশ সুতরাং সে ধর্মই যেন প্রাধান্য পায়। এরকম ঘটনা যদি অন্য যে কোনো সাময়িকীর ক্ষেত্রে ঘটত তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কালের খেয়াকে কেন্দ্র করে আরোপিত, ফরমায়েশি লেখক গড়ে উঠুক; এমনটা কখনোই কাম্য নয়।
আমরা যারা পাঠক তারা জানি, গল্পকারকে সমাজ, সময়, সংস্কার ও কাহিনী র্বণনায় সজাগ থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় লেখাটা যেন শুধু শুধু কলমের টানে এগিয়ে না গিয়ে বিবেক-বোধ, যুক্তি ্টারা পরিচালিত হয়। সেসঙ্গে পাঠকের আস্থা ও চাহিদাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনও রয়েছে। আরোপিত কাহিনী পাঠকরা চিরকালই প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে লেখককেও। কিন্তু এমনটি যেন উম্মে মুসলিমার ক্ষেত্রে না ঘটে। কারণ এই গল্পকারের লেখার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে। শুধু ক্ষমতাটা একটু যাচাই করে একটা গল্প তার কাছে যতটুকু সময় দাবি করে সেই অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত। আর একজন পাঠক হিসেবে তার কাছে এটুকু দাবি নিশ্চয়ই করতে পারি?
সুমন আজাদ
শাবিপ্রবি, সিলেট


প্রকাশিত লেখার লিংক

শাবিপ্রবির জটিলতা দূর হোক/সুমন আজাদ

শাবিপ্রবি বন্দ। এ কথাটা এখন সবার জানা। কিন্তু কেউই জানেন না, খুলবে কবে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ক্যাম্পাস আজ নিথর। নিথর ক্যাম্পাসে শুধু হেঁটে বেড়ায় কিছু বিষণম্ন শিক্ষার্থী। অসহায় চোখগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চারপাশের জড় দালানগুলো। আর জড় পদার্থগুলোকে দেখে শুধু মনে পড়ে এমন স্বভাবের কিছু মানুষের কথা, যাদের জন্য আজ থেমে আছে সাড়ে ৬ হাজার ছাত্রছাত্রীর সুন্দর ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রা। কী এমন ঘটেছিল যার জন্য আজ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে শাবিপ্রবি অচল?
চলুন জানা যাক সেদিনের কথা : আর সব স্বাভাবিক দিনের মতো সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেছে সবাই। বিভিন্ন ডিপার্টমেনাউটর পরীক্ষা ছিল কাছাকাছি সময়। আর তাই যে যার মতো করে প্রস্থুতি নিচ্ছেল। সন্দ্যার পরপরই রটে যায়, শাবির কিছু ছাত্রকে পাঠানটুলায় রাকীব-রাবেয়া কলেজে আটকে রাখা হয়েছে। সহপাঠী বন্দুদের এমন অবস্থার খবর শুনে কেউই বসে থাকতে পারেনি। তিন কিলোমিটার দূর থেকে ছাত্র হলগুলোর ছাত্ররা ছুটে আসে রাকীব-রাবেয়া মেডিকেলের সামনে। সময়ের ব্যবধানে সেখানে আগেই পুলিশ অবস্থান নেয়। পুলিশের সঙ্গে মেডিকেল কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে যখন ছাত্রদের কথা কাটাকাটি চলছে, তখন আগ্রহী কিছু ছাত্র গেটের ভেতরে ঢুকে এগুতে চাইলে পেছন থেকে গুলি করে পুলিশ। গুলির সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কয়েকটি তাজা প্রাণ। পুলিশের আকস্টি্মক আক্রমণে সবাই যেন হতবাক। তাৎক্ষণৎ আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোনো গাড়ি না পেয়ে পুলিশের কাছে গাড়ি চাইলে তারা তা দিতে অপারগতা জানায়। যেন তারা ক্রসফায়ার করে ফেলে রেখেছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের দেহ!
এসব ঘটনা পর্যন্ত আমাদের উপাচাযরাউর কোনো ভূমিকাই ছিল না! সঙ্গত কারণেই সহপাঠীদের হাসপাতালে রেখে এসে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেই রাতেই উপাচাযরাউর বাসভবন অবরোধ করে। পরে পুলিশের গুলিতে আহত শামীম মারা গেলে সব শিক্ষার্থী উপাচাযরাউর পদত্যাগ দাবি করে। অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের মুখে এক সময় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, যা ছিল সেই মুহহৃতরাউ প্রত্যাশিত। তখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্দ ঘোষণা করলে সবাই ভাবে যে গ্রীষ্ফ্মের ছুটির পর খুলে যাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উপাচার্য আবার স্বপদে ফিরে এলেন। তাই আবারো নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় শাবিপ্রবি নিয়ে। পরে উপাচাযরাউর পদত্যাগ ও শামীম হত্যাসহ যাবতীয় ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদনেস্নর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিরসনে যেসব শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কিংবা বাম ধারার তারা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপাচাযরাউর পদত্যাগই একমাত্র সমাধান মনে করে তারা কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। ডানপন্থি শিক্ষকরা এ পরিস্থিতিতে উপাচাযরাউর পক্ষে অবস্থান নিলেও সব শিক্ষকই চান শিক্ষা কার্যক্রম যেন শুরু হয়। তবে আশ্চর্য এক কারণে উপাচার্য আজো বহাল আছেন। কিন্তু র্বতমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিষয় সুনিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মুখোমুখি দুটি দল। এক. যারা ভিসির পদত্যাগ দাবি করছে। দুই. ভিসি নিজে। কারণ ভিসির পদত্যাগের জন্য যারা আন্দোলন করছে তাদের আন্দোলন ভিসি পদত্যাগ করলেই থেমে যাবে। অপরদিকে যারা সরকারপন্থি বা ভিসির পক্ষে, তারা কখনোই ভিসি পদত্যাগ করলে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করবে না। কারণ ভিসি যখন প্রথমবার পদত্যাগ করেন তখন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো আন্দোলন হয়নি। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সিলেটের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এই শাবিপ্রবি নিয়ে নেতাদের নিষ্ফি্ক্রয়তা। আজ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী-এমপি শাবি নিয়ে একটি কথাও বলেননি। সরকারি কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীরা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। তারা একবারও এই সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা নিজেদের মূল্যবান কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন না! অথচ এদেরও ভোট আছে! আছে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ছোট-বড় একটা পরিবার। যারা নিশ্চয়ই ব্যালটে সিল দিতে এ কথা মনে রাখবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যথেষ্ঠ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে থাকে এক একজন শিক্ষার্থী। এসব মেধাবী ছাত্রছাত্রী শিক্ষাজীবনে বারবার বাধাগ্রস্ত হলে সঙ্গত কারণেই হতাশ হয়ে পড়ে। আমাদের মতো দেশে শিক্ষাজীবন শেষে এক একজন শিক্ষার্থীর যে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে, তা মোটেও সুখকর নয়। তারপরও যদি মেধাবী মাথাগুলো ব্যর্থতার দায়ে এখনই নুয়ে পড়ে, তার দায় কে নেবে? উপাচার্য যে এলেন কে গেলেন_ এতে আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মাথাব্যথার তেমন কিছু নেই। আমরা শুধু চাই বিশ্ববিদ্যালয় চলুক তার আপন গতিতে। আর সেই গতিধারার সঙ্গে ভালো মিলিয়ে চলুন তারুন্যের স্বপম্নবুনন। এক একটি চোখ জ্বলজ্বল করে উঠুক সম্ভাবনার দু্যতি নিয়ে। শাবি ক্যাম্পাস থেকে শুরু হোক তারুন্যের জয়যাত্রা। আর সেই জয়যাত্রার পালে কখনো যেন না লাগে একটিও অনাকাঙ্খিত পালক।
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট

সমকাল
প্রকাশিত লেখার লিংক

প্রসঙ্গ : শহীদ কাদরী

সত্তর দশকে দেশত্যাগী, স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে সমকালের শুক্রবারের আয়োজন 'কালের খেয়া' হাতে পেয়ে কতটা মুগ্গব্দ হয়েছি তা প্রকাশ করার মতো নয়। মুগ্গব্দতার পরক্ষণেই অবশ্য বেদনার্ত হয়ে যায় হূদয়। কারণ শহীদ কাদরী নামটা উচ্চারিত হলে আর যেসব প্রসঙ্গ চলে আসে তা হলো_ শামসুর রাহমান, আল মাহমদু, বিউটি বোডর্িং ইত্যাদি। সময়ের পরিক্রমায় সব কিছুই মোটামুটিভাবে চলমান ছিল গত বৃহস্পতিবার সন্দ্যা ৬টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু এ বেলায় এসে নিভে গেল শামসুর রাহমানের জীবনপ্রদীপ। আর সেই শামসুর রাহমান এবং শহীদ কাদরীর প্রসঙ্গই উঠে এলো হাসান ফেরদৌসের লেখায়। জ্ঞানগর্ভ সে প্রচ্ছদ রচনা পড়ে আরো জানা গেল শহীদ কাদরীর র্বতমান প্রবাস জীবনের খ-চিত্র। সৌম্য দাশগুপ্ত ও অংকুর সাহার সঙ্গে শহীদ কাদরীর পত্রালাপ (যাকে লেখক্টয় সাক্ষাৎহীন সাক্ষাৎকার বলেছেন) হওয়া সত্ত্বেও তা অনেকটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে উপস্থাপনের ধারাবাহিকতার জন্য।
শহীদ কাদরী ও তার প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরও যদি আলাদাভাবে বইগুলোর প্রকাশকাল ও তিনটি বই থেকে নির্বাচিত অন্তত তিনটি কবিতা পুনমর্দু্রিত হতো তাহলে মনে হয় সংখ্যাটা আরো পরিপূর্ণ হতো। তবুও কালের খেয়াকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, কালের খেয়া সব সময় তার পাঠকের চাহিদাকে মূল্যায়ন করে। কালের খেয়া সম্পাদক আরো অগণিত পাঠকের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবেন; যদি তিনি অসুস্থ কবি শহীদ কাদরীর স্মৃতিকথা ও কবিতা বিষয়ক টিকা-টিপ্টপ্পনিগুলো উদ্ধারের (লেখিয়ে নেওয়ার) ব্যবস্থা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একটি বিভাগ হচ্ছে 'পাঠকের কলম'। সেখানে তানজীব-উল-আলমের চিঠি পড়ে মনে পড়ল বিগত এক সংখ্যায় সিলেটের কামরুজ্জামান হেলাল যে মন্তব্যগুলো করেছিলেন সুব্রত আগাসি্টন গোমেজ, টোকন ঠাকুর ও সাহিত্য পাতায় লেখা প্রকাশ নিয়ে তার প্রেক্ষিতে কিছু বলা দরকার। অবশ্য সুব্রত আগাসি্টন গোমেজ তার জবাব দিয়েছেন পরর্বতী সংখ্যায়। তাই আমি বলতে চাই টোকন ঠাকুর প্রসঙ্গে।
আমার মনে আছে, কয়েক মাস আগে সমকালের উদ্যোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুহূদ সমাবেশ তিন দিনের একটি কর্মশলার আয়োজন করেছিল। সে কর্মশালায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাইরের অনেক অংশগ্রহণকারীর মধ্যে কামরুজ্জামান হেলালও ছিলেন। আর সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টোকন ঠাকুর। কবিতা বিষয়ক আলাপচারিতায় দু'দিন বরাদ্দকৃত সময়ে অনেক অন্তরঙ্গ মুহহৃর্ত তিনি সুহূদদের সাল্পিম্নধ্যে কাটান। সেসব আলোচনায় অনেক প্রশ্ন-উত্তর পবরাউ অন্যান্য অংশগ্রহণকারীর মতো হেলালও অংশ নিতেন। তবে তার বেশির ভাগ তত্ত্বের উৎস ছিল 'নয়া দিগন্ত' কিংবা 'সংগ্রাম'। আমার মনে আছে, সৃষ্টিশীলতার চর্চায় ওইসব পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বলে হেলাল দাবি করলে তার প্রেক্ষিতে ওইসব পত্রিকার উদ্দেশে টোকন ঠাকুর বলেছিলেন, 'জামায়াতের প্রোডাকশন আর কতটা ক্রিয়েটিভ হবে, সে আমাদের জানা আছে।' তখন চুপ মেরে যাওয়া হেলালের পরর্বতী সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে একজন সিনিয়র কবিকে অপদস্থ করার প্রক্রিয়া দেখে প্রশ্ন জাগে, দু'দিন কাছে পেয়েও যে হেলাল টোকন ঠাকুরকে তার কবিতা নিয়ে একটি প্রশ্নও তুললেন না সেই হেলাল কোন উদ্দেশ্যে পত্রিকায় চিঠি লেখেন?
ধন্যবাদ তানজীব-উল-আলম সেসব পত্র লেখকের আসল উদ্দেশ্য কালের খেয়ায় তুলে ধরার জন্য।

লেখার লিংক

সাহিত্যিক পার্থ সারথি চৌধুরী'র সাক্ষাৎকার



পার্থ সারথি চৌধুরী
পার্থ সারথি চৌধুরী হবিগঞ্জের সাহিত্য অঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫১ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ১৩৪৭ বাংলা ৯-ই পৌষ হবিগঞ্জ শহরের বগলা বাজার এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা অঘোর চৌধুরী, মাতা রানী চৌধুরী। হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাল্যশিা শুরু করে ১৯৬৬ সালে তিনি এস.এস.সি পাশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন 'মনন গ্রুপের' হবিগঞ্জ শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ও তখনকার সময়ে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি ছিলেন।কলেজ জীবন থেকেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। কলেজে অনুষ্ঠিত বিতর্ক, আবৃতি, স্বরচিত কবিতা, প্রবন্ধ ও উপস্থিত বতৃতায় তিনি বরাবরই ১ম স্থান অধিকার করতেন। হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা 'অভিযাত্রিক' এ লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে সিলেট বার্তা পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট হরিপুর গ্যাস ফ্যাক্টরী হাই স্কুলে শিকতা করেন। এ সময় তিনি সিলেটের সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণ করেন। হবিগঞ্জের বহু সাহিত্য সাময়িকী তিনি সম্পাদনা করেন। 'দ্বান্ধিক' ও 'প্রয়াস' তাঁর সম্পাদিত দুটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সাময়িকী। ১৯৭৮ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। দেশবার্তা, যুগভেরী, গ্রাম সুরমা, স্বাধিকার, হবিগঞ্জ সমাচার, হলিডে ও লাল সবুজ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সংবাদ, ফিচার ও কলাম লিখতেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পত্রিকায় দীর্ঘদিন নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বসন্তে বৈশাখ' বের হয়। ১৯৮৪ সালে ২য় কাব্যগ্রন্থ 'শিরীষতলার গাঁথা' বের হয়। পাঁচ শতকেরও অধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। প্রথম উপন্যাস 'আমৃতু্য বাসনার লোকালয়', 'অধরা অভিসার' ও 'রাত্রির যৌবন' নামে ২টি উপন্যাস লিখেন। তাঁর ধারাবাহিক রম্য রচনা 'অশ্বডিম্ব', 'অচলপত্র', 'রূপান্তর' বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পার্থ সারথি চৌধুরীর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে তিনি হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনের ১০০ বছরের ইতিহাস গ্রন্থনা করে 'কল্লোলিত হবিগঞ্জ' নামে একটি বই বের করেছেন। সাপ্তাহিক স্বাধীকারে প্রকাশিত 'অজানা বাঁশির টানে' ভ্রমণ কাহিনী পাঠক মহলে সাড়া জাগায়। 'কাণ্ডকারখানা' নামক প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থে তিনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ঠ্রীয় জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির রসাত্বক প্রকাশ করেছেন। কবি পার্থ সারথি চৌধুরীর আরো একটি পরিচয় না বললেই নয়, তিনি একজন ভাল আবৃতিকার ও সুবক্তা। তবে ১৯৮৪'র পর থেকে আজোবদি তিনি স্বেচ্ছায় সাহিত্যের সব শাখা-প্রশাখা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

বটতলা চেয়েছে এই কবির কবিতার ভাষায় তাঁর সাথে আরাপচারিতা চালাতে। যেন 'কবি ও কবিতা' উভয়কে প্রাসঙ্গিক ভাবে উপস্থাপন করা যায়।



আরাপচারিতায় অংশগ্রহণ করেনঃ
তানসেন আমীন আহমেদ রনি সুমন আজাদ



"কতবার বিক্রি হলাম বেচা কেনার হাটে/তাই তো এখন ঘুমিয়ে আছি তেপান্তরের মাঠে"('প্রোফাইল' / বসন্তে বৈশাখ)

্# আপনি এখনো তেপান্তরের মাঠে ঘুমান নি। দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন বগলা বাজারের বাসায়। তাই যদি প্রশ্ন করি 'কেমন আছেন' উত্তরে কি বলবেন?

্# হ্যা, ভালোই আছি। তবে চোখে ইদানিং খুব বেশী সমস্যা হচ্ছে। বলতে পারো চোখের ৮০% ই অকেজো।

***********************


"... যখন সবুজ ছিলাম/সোনালী রোদের বন্ধু ছিলাম। এখন/সময়কে খুন করে কী অদ্ভুত খুনী হয়ে গেলাম।"('ঘণ্ঠা বেজে গেছে' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# সেই ১৯৮৩ থেকে আজোবধি সময়কে হয় আপনি খুন করেছেন নয় তো খুন হয়েছেন। এই মধ্যবর্তি সময়ের শিথিলতাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

্# দেখো, দীর্ঘদিন ধরে আমার শরীরে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। চোখের সমস্যার কথা তো বলেছি, এছাড়া আমার কিডনীতে সমস্যা ছিলো। বিভিন্ন কারণে আমি সক্রিয় ভাবে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারি নি।

"ঘণ্ঠা বেজে গেছে ট্রেন এখন চলবেই/সময় ঘুমন্ত নয় অনিকেত ঘুমন্ত সত্তায়/চার্বাক ঘুমিয়ে আছেন অনন্ত স্রোতের সাথে/ঈশ্বরের ভালবাসা তীব্র হয়ে উঠে, অতঃপর.../........../ট্রেন তুমি থেমো না, ঘণ্ঠা বেজেছে তোমার"('ঘণ্ঠা বেজে গেছে' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# কবিতার ট্রেনটি জীবনের মতই গতিময়। সেই গতিতে আপনি পিছনে ফেলে এসেছেন এক একটি স্টেশন অর্থাৎ শৈশব- কৈশোর-যৌবন। আর এখন অতিক্রম করছেন বার্ধক্যের সীমানা। আমরা আপনার বেড়ে উঠার কাল অর্থাৎ ফেলে আসা দিনগুলোর কথা শুনতে চাই।

্# আমার শৈশবের অনেকটাই আবদ্ধ পরিবেশে কেটেছে। তোমরা জানলে অবাক হবে যে, আমি আমার জীবনে প্রথম কামড়াপুর গিয়েছি পাঁচ বছর পূর্বে। ছোট বেলা থেকেই বাহিরের পরিবেশের সাথে না মেশার ফলে এটা হয়েছে। আমার বাসার পেছনেই রেল লাইন ছিল। যখন থেকে বেরুতে শুরু করলাম, তখন রেলগাড়ি, রেল লাইন আমাকে ভীষণ টানতো। রেল লাইন ধরে হাঁটতাম। কখনো কখনো টিকেট ছাড়াই চলে যেতাম পরবর্তি স্টেশনে। এ সময়টা বেশ উপভোগ্য মনে হত। পরে ক্রমশ আবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করতে শুরু করি। সে সময় লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, সিনেমা দেখা, রাত জেগে যাত্রা দেখা; সবই করেছি।

্# কিভাবে লেখালেখি শুরু করেন? কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি?

্# আমি ছোট বেলা থেকেই আবদ্ধ ঘরে বেড়ে উঠেছি। সে সময় থেকেই দেখে এসেছি আমাদের ঘরে অনেক অনেক বই। আমার বাবা, কাকা,, দাদা-দাদী, পিসিমা সবাই বই পড়তেন, পত্রিকা পড়তেন। এভাবে আমিও বইপত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমার এক নানা যিনি ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ের সংস্কৃতের একজন বড় পন্ডিত। ঐ পরিবারেও সংস্কৃতি চর্চাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হত। আমাদের বাড়িসহ ঐ বাড়ির অনুষ্ঠানাদি প্রত্য করার সুযোগ আমার হত। তাছাড়া আমার বাবার কাকাতো ভাইদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি বিশ্বভারতীর তিন বারের উপাচার্য এবং ইন্ডিয়া গর্ভনমেন্টের অডিটর জেনারেল। উনার নাম ডঃ িিতশ চৌধুরী। আরেকজন ছিলেন উনার ছোট ভাই, যিনি 'ইউরোপের ইতিহাস' নামে একটা বই লিখেছিলেন। এই পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রভাব আমার উপর প্রত্য বা পরো ভাবে পড়েছে।




"কিছু কিছু স্মৃতি আছে; আমার কিছু কিছু/স্মৃতির শহর আছে, গভীর বিজন হৃদয় পটে/বিস্মৃতিরই খেলাঘরে।"('কিছু কিছু স্মৃতি আছে' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# আপনার স্মৃতির শহরের স্মৃতির মানুষগুলোর কথা বলুন, হবিগঞ্জে তৎকালীন কবিতা-প্রিয়দের সংগঠন 'শব্দ-শিল্পী'র কথা বলুন।

্# 'শব্দ-শিল্পী' প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হওয়ার পূর্বে, পাকিস্তান আমলেই। আমরা কবি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা'র বাসায় বসতাম। আমাদের মধ্যে ছিলেন বৃন্দাবন কলেজের বাংলার অধ্যাপক বশীরুল হক, আব্দাল করিম, মোস্তফা শহীদ এম পি, সুর বিতানের সেক্রেটারী আজিজ, ইসমাইল তরফদার। মহিলা একজন ছিলেন_ রৌশন আরা রেবা। আমরা প্রতি সপ্তাহে অথবা ১৫ দিনে একবার ঘরোয়া ভাবে কবি সাহেবের বাসায় বসতাম। কেউ কবিতা বা গল্প নিয়ে এলে এখানে তা পাঠ করা হতো এবং এর উপর আলোচনা হত। আরও দুজন ছিলেন আমাদের সঙ্গে এডঃ নাজমুল হক নোমান, যিনি মনে হয় মারা গেছেন, আর অন্যজন আরিফ চৌধুরী; ভালো লিখতেন। মহিলার সংখ্যাও নগন্য ছিল না। প্রতি সপ্তাহেই আলোচনা হত। একটা পত্রিকা ছিল 'মৌলিক গনতন্ত্র' এটা আসলে আইয়ূব খাঁর মুখপত্র ছিল, তবে এতে শিল্প-সাহিত্যের নানা দিক নিয়েও আলোচনা হত। এভাবেই অনানুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় 'শব্দ-শিল্পী'। পরবর্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংগঠনটি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ সময় বৃন্দাবন কলেজের বাংলার শিক মতীন্দ্র সরকার, প্রফেসর মুক্তাদির, আব্দুল্লাহ (এখন মনে হয় অধ্যাপক হয়েছে) এবং প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আরো একজন শিক আমাদের সঙ্গে ছিলেন; বাবু নৃপেন্দ্র লাল দাশ। স্বাধীনতার পূর্বে সংগঠনের প্রতি উনার ব্যাপক অবদান ছিল। অনেক তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সবার নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। তবে মহিবুল হুসেন জিতু, দিলদার হোসেন দুলাল (এখন মনে হয় জজ হয়ে গেছে), মানিক দেব, ইসমাইল, আজিজ, শাহান উদ্দিন ছিল। শাহানারা নামে একটা মেয়েও ছিল। সংগঠনটা চলার জন্য মাসিক একটা চাঁদা ছিল।

্# সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যটা কি ছিল?

্# সাহিত্য, স্রেফ সাহিত্য; আর কিছু না। এখানে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হত, মাঝে মাঝে ম্যাগাজিন বের করার চেষ্টা করা হত। আমাদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু খারাপ ছিল অথচ ভালো লিখত তাদের বই বের করার জন্য আর্থিকভাবে সাহায্য করা হত।

্# সংগঠনের আর্থিক সহায়তায় বই প্রকাশ করেছেন এমন দু-এক জনের নাম মনে আছে?

্# হঁ্যা। চুনারুঘাটের গিরীশ রঞ্জন নাথ'র একটা বই প্রকাশ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন গর্জিয়াস অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। বিভিন্ন জন্ম দিবস, মৃতু্য দিবসের অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে পালন করা হত। অনেক সময় ঘরোয়া ভাবে পালন করা হলেও আনুষ্ঠানিকতা ছিল। আমাদের এ সংগঠন থেকে প্রচুর সংখ্যক ছেলেমেয়ে সাহিত্যাঙ্গনে উঠে এসেছে। এখন যে উঝ হিসেবে রিটায়ার করেছে শেখ ফজলে এলাহী বাচ্চু সেও ব্যাপক ভাবে এটাতে ছিল। এভাবে... মনে কর, বিভিন্ন সময়ে 'শব্দশিল্পী'র প্রায় শ'খানেক সদস্য হয়েছিল। প্রবীণদের মধ্যে এডঃ নূরুল হক সাহেব এবং এম পি আবু লেইছ মুবিন সাহেবের মামা কবি শামসুদ্দিন সাহেব, তিনিও ছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে নেই_ 'শব্দশিল্পী'র ইতিহাস কোন একটা কাগজে লিখেছিলাম, জিতুও মনে হয় লিখেছিল।

্# আপনার কথা থেকে বলা যায় 'শব্দশিল্পী' হবিগঞ্জের তৎকালীন সাহিত্য অঙ্গন নিয়ন্ত্রন করত?

্# হ্যাঁ, ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এটা ঠিক ছিল। তারপর আর সে ভাবে থাকে নি। সেই সময় কবি সাহেবের উদ্যোগে বিভিন্ন গুণি ব্যাক্তি হবিগঞ্জে এসেছেন। একজনের নাম বলা যেতে পারে; পটুয়া কামরুল হাসান, যিনি এরশাদকে 'বিশ্ব বেহায়া' বলেছিলেন। 'শব্দশিল্পী'র একটা অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন।

্# আপনার ভাষ্য মতে জানা যায়, ঐ সংগঠনে বিভিন্ন বয়সের লোকজন জড়িত ছিলেন। তাহলে পরবর্তিকালে সংগঠনের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ার কারণ কি? কোন আইডিওলজিক্যাল কারণে এটা ভেঙ্গেছিল কি?

্# ঠিক আইডিওলজিক্যাল কারণে নয়। সব বিষয় বলা ঠিক না...। আসলে আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতার্দশের লোক থাকলেও আমরা চাইতাম শিল্প সাহিত্যের ত্রে হিসেবে 'শব্দশিল্পী' নিরপে থাকুক। এছাড়া আমরা চাইতাম কবি সাবকে একজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী লোক হিসেবে দেখতে।

্# কবি দেওয়ান গোলাম মোতর্াজা কি এই সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন?

্# হ্যাঁ। উনাকে কেন্দ্র করেই এটা গড়ে উঠেছিল। যদিও অরগানাইজে আমি বা আমার সঙ্গী কয়েকজন ছিল। আমি সব সময়ই সংগঠনের সঙ্গে ছিলাম। অসুস্থ হওয়ার পর আমি চলে আসি। আমাদের মধ্যে অনেকেই চাকুরী নিয়ে, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বিদেশ চলে যান, আবার অনেকে মারাও গিয়েছেন।

্# 'শব্ধশিল্পী'র পরবর্তীতে হবিগঞ্জে এ ধরণের আর কোন সংগঠন না দাঁড়ানোর কারণটা কী?

্# ভাল অরগানাইজারের অভাব। এটা তো হল অনেকটা 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র মত ব্যাপার। সবাই এতে আসতে চায় না। একটা বিষয় বুঝতে হবে, সাহিত্য এমন একটা ব্যাপার যেখানে সংগঠন করে বা আড্ডা দিয়ে সাহিত্য হয় না, তোমাকে যা করতে হবে তা হল নিজের পড়ালেখার উপর ভিত্তি করে নিজেকে গড়ে তোলতে হবে। একটা সংগঠন করে তুমি কিছু পদ পেতে পারো কিন্তু তোমার মধ্যে যদি চড়ঃবহঃরধষরঃু বা শৃজনশীলতা না থাকে তবে সত্যিকার সাহিত্য বেড়িয়ে আসবে না। চড়ঃবহঃরধষরঃু থাকলে এটা অঁঃড়সধঃরপধষষু প্রকাশিত হবেই। 'শব্দশিল্পী' না থাকলেও আজকে যারা লেখালেখি করছে তাদের অনেককেই পাওয়া যেত। কিছু কিছু েেত্র সংগঠন হয়তো তাগিদ দিয়ে দাঁড় করানোর পেছনে একটা অবদান রাখে। আমি বা কবি সাব আমরা 'শব্দশিল্পী' না করলেও আমাদের লেখা এভাবেই সৃষ্টি হত।
খুব যে বেশী লেখালেখি হয়েছে তা-তো নয়। বিষয়টা হচ্ছে বাস্তবতা। হয়তো একজন চাকরী করে, তার সময় কোথায়? তার মনে হয়তো খেলা করে অনেক বিষয় কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে লেখালেখি করতে পারে না। সবাই তো আমার মত বেকার থাকে না, তাই না?

্# আপনি বলেছেন, 'একজন লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে কিন্তু সাহিত্যের েেত্র সে নিরপে থাকবে'_ এটা কি সম্ভব?

্# না...না; নিরপেতা থাকবে অরগানাইজেশনের েেত্র। লেখার েেত্র একজন তার মতাদর্শ অবশ্যই ব্যক্ত করার অধিকার রাখে। কিন্তু যখন কোন সংগঠন করার প্রশ্ন আসে তখন সেেেত্র সংগঠনকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরপেতা প্রয়োজন। আমার কথা হলো, এটা একটা প্লাটফর্ম এখানে নিজেদেরকে গোষ্টিভুক্ত করে কোন রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি থাকবে না। আমি বিশ্বাস করি; সাহিত্য মানে প্রগতিশীলতার চর্চা। প্রগতিশীল হলে সংগঠনে আসবে, না হলে আসবে না।

্# আপনি বললেন, সাহিত্য মানে প্রগতিশীলতার চর্চা, কিন্তু বর্তমানে অনেক সাহিত্যই প্রতিক্রিয়াশীলতার বাহনে পরিণত হয়েছে...

্# হ্যাঁ, এটা ঠিক। সাহিত্যের নামে এসব হচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি; দুয়েকটা সংগঠনে আমি ছিলাম, একটা সময় দেখলাম সংগঠনের নামে যা হচ্ছে তাতে আমার থাকা চলবে না। আমি চলে এলাম।

্# এরকমও হয়েছে, একজন বক্তব্য দেয়ার পরে অন্যজন মঞ্চে উঠে এসে বলল যে, এটা উনার ব্যক্তিগত বক্তব্য; আমাদের সংগঠনের নয়।

্# হাঃ হাঃ... ঘটনাটা শুনেছি।

"...স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়/তবুও দেয়াল ভাঙ্গতে চাইনা।"('একজন মধ্যবিত্ত আমি' / বসন্তে বৈশাখ)

্# আপনার এই উক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আপনার পরাজয় নাকি সব কিছু মেনে নেয়ার ব্যর্থ অজুহাত বলে ধরে নেব?

্# এই উক্তি যে আমার েেত্র প্রযোজ্য তা না। এখানে টোটাল মধ্যবিত্ত সমাজ, তার যে চরিত্র, চরিত্রের স্বরূপ, পুরো চারিত্রিক অবস্থানটা প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত সমাজের বৈশিষ্ট্যটা কি? সে সংগ্রাম চায়, সে আন্দোলন চায় কিন্তু সে নিজে এটাতে জড়িত হতে চায় না। সে পরিবর্তনে শামিল হয় না; সে ভীতু! সামাজিক পরিবর্তনে তার মানসিক অবদান আছে কিন্তু শারীরিকভাবে সে অনুপস্থিত।

্# তবে কি মধ্যবিত্ত আপোষকামী?

্# হ্যাঁ, অবশ্যই আপোষকামী। সেজন্য-ই তো এদেশে এখন পর্যন্ত কোন সমাজ বিপ্লব হয় নি! ভারত বর্ষের কথা চিন্তা কর। এখানে সচেতন শ্রমজীবি মানুষের সংখ্যা সব সময়ই কম। মধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশী। মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত অবস্থান তাকে বিপ্লবী হতে দেয় না, যদিও বা দুয়েকজন বিপ্লবী হতে চেয়েছে, আমার মতে 'রোমান্টিক বিপ্লবী' হয়েছে। যেমন; চারু মজুমদার.... আব্দুল হক সাহেব, তোহা সাহেবদের অবস্থাও ছিল সে রকম।

্# মধ্যবিত্তের প েতার শ্রেণী চরিত্র ডিঙ্গিয়ে কি বিপ্লবী হওয়া সম্ভব?

্# হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে এটা হয়েছে। যেমন; কমরেড মোজাফফর আহমদ, মণি সিং, অজয় ভট্টাচার্য্য এদের েেত্র এটা সম্ভব হয়েছে।

্# আপনি কি প্রতিষ্ঠান বিরোধী?

্# হ্যাঁ, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী। আসলে এখানে প্রতিষ্ঠান বলতে আমি বুঝি দঊংঃধনষরংযসবহঃ্থ। আমাদের 'শব্দশিল্পী' কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। এটা ছিল একটা প্লাটফর্ম। এখানে কোন বাধ্য-বাধকতা ছিল না। যেমন; চাঁদা দেয়ার ব্যাপারে বা সদস্য হওয়ার ব্যাপারে কিংবা লেখার ব্যাপারে।


***********************



"ভয়ে ভয়ে এবার চোখ খুলো। দেখছোনা/মধ্য প্রাচ্যের আকাশে এখন বারুদের ঝড়/কাল বোশেখীর মতো ফুঁসে ফুঁসে উঠছে।"('উনিশশ' পঁচাশী খ্রষ্ঠাব্দ' / বসন্তে বৈশাখ)

্# আজো আমরা ভয়ে ভয়ে চোখ খুলি। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এখনো বারুদের টাটকা গন্ধ। একজন সচেতন কবির কাব্য সৃষ্টিতে সমকালীন চিন্তা স্থান পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তারপরও আমরা এর কারণটা জানতে চাচ্ছি?

্# হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় নি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে কিন্তু পরিপ্রেতি তো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। আমরা দেখি, একতরফা একটা ব্যাপার হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত প েএকতরফা কোথায়? আজকের যে আলকায়েদা, তা কি ঐ বৃহৎ শক্তির জন্য একটা বিদ্রোহী শক্তি হিসেবে আত্ন-প্রকাশ করেনি? করেছে। আলকায়েদা'র আর্দশকে আমি সমর্থন করি না কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতাকে আমি প্রসংশা করি।

্# মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি কি কোন দিন দূর হবে না?

্# হ্যাঁ, হতে পারে। মানুষ যদি দাঁড়িয়ে যায় তবে শান্ত হবে। হয়তো আপোষও করতে হতে পারে, যেমন ধর নেপালের অবস্থা। সেখানে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল যাতে যে কোন সময় কমিউনিস্টরা মতায় আসতে পারত, কিন্তু একটা আপোষ হয়ে গেল। কমিউনিজমই যে সঠিক তা-ই বা বলি কি করে? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গে কেন? যেখানে বলা হল শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব সেখানে পারিবারিক একনায়কত্ব কেন আসে? মাওয়ের পারিবারিক একনায়কত্ব কেন আসবে? স্ট্যালিনের পারিবারিক একনায়কত্ব কেন আসবে? চসেস্কুর পারিবারিক একনায়কত্ব কেন আসবে? প্রশ্ন হল এসেই যাচ্ছে...। আমি এক সময় কমিউনিজমের পূজারী ছিলাম কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি এখনো অনুরূপভাবে কমিউনিজমের পূজা করব। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে মতা কোথায়? যারা আন্দোলন করে নেতা হল তারা তো অন্য ধরণের একটা রাজতন্ত্র কায়েম করেছে।

্# শ্রমিক শ্রেণী থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি এখন এলিট হয়ে গেছেন, তারা শ্রমিকের সঙ্গে নেই...

্# হ্যাঁ, তাই হয়েছে।

্# 'যে কোন তত্ত্ব-ই একটা সময়ে এসে তার কার্যকারিতা হারায়' মাকর্সবাদের েেত্র উক্তিটি কতটা প্রযোজ্য?

্# দেখ, কমিউনিজমের মূলতত্ত্বটা কি? তা হল_ দ্বান্ধিক বস্তুবাদ। দ্বান্ধিক বস্তুবাদটা কি? তা হল; থিসিস-এন্টিথিসিস ঞযবহ সিনথিসিস। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া এটা চলতেই থাকবে। এ েেত্র যা হয়েছিল, যেখানেই কমিউনিস্টরা মতায় গিয়েছিল, মতায় গিয়ে তারা প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দিল। মতাবানরা শাসক গোষ্টিতে পরিণত হল। সোভিয়েত ইউনিয়নে ট্রটস্কির একটা বিরোধিতা ছিল। ট্রটস্কি বলেছিল, একটা দেশে কমিউনিজম চালু হলেই কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না; অনবরত প্রক্রিয়ায় সারা বিশ্বেকেই এক বিশ্ব করে নিতে হবে। এটাতে অবাস্তবতা থাকলেও তত্ত্বের দিক থেকে এটা খুব সুন্দর। ব্যাপারটা হল যে, মাকর্স এর কথাগুলো তো সব েেত্র অনুসরণ করা হয় নি। মাও চেষ্টা করেছিলেন; ব্যর্থ হয়েছেন। আজকে যাকে মাওইজম বলে এটা ফালতু কথা, এটা ঠিক না, এটা মার্কসইজমই। আজকে চীনে কি অবস্থা? চীন তো সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে আছে। চীনে নামে কমিউনিস্ট পার্টি আছে কিন্তু তা পুঁজিবাদের আখড়া। এক সময় শোনা যেত চীনে না খেয়ে মানুষ মারা যায় না, এখন শত শত মানুষ না খেয়ে মারা যায়। বিষয়টা হল যে, মাকর্স এর নীতিটা সঠিক ভাবে অনুসরণ করা হয় নি, যে সময় যে দল মতায় গেছে কমিউনিজমের নামে তারা নির্দিষ্ট ধিু তে শাসন করেছে।

্# ভবিষ্যতে মার্কসবাদ'র চেয়ে ভালো তত্ত্ব কি আমরা আশা করতে পারি?

্# এটা সময়ের ব্যাপার। তবে আমি মনে করি, তত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে মার্কসবাদ অনন্য। যতদিন বিশ্ব-ভ্রমাণ্ড থাকবে ততোদিন মার্কসবাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এটা হল তত্ত্বের দিক কিন্তু বাস্তবতা তো অন্য জিনিস। যেমন কাউকে যদি বিপ্লবের কথা, সংগ্রামের কথা বলা হয় আর অন্য দিকে ল ল টাকা দেয়া হয়, তবে সে টাকাটাকেই বেশী মূল্য দেবে। একটা রূপান্তর ঘটানোর জন্য যে প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় নি। মানুষ সাধারণত ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার টার্গেট নিয়েই বেশী ভাবে, সমগ্র মানব জাতির কল্যানের বিষয়টা চিন্তা করা সহজ সাধ্য বিষয় নয়।






"এশিয়ার বেকার যুবকের হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে/অন্ধ প্রকোষ্ঠে, উষ্ণ রক্ত-চাপে ভেঙ্গে যাচ্ছে যুবতীর/স্বপ্নময় অহংকার। ওখানে চকচকে সূর্য বড়ো বেমানান/অনুজ্জ্বল।"('তুমিও ফেরাবে মুখ' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# আপনার কবিতার রচনাকালের সাথে আমাদের জন্ম থেকে এখন যে বয়েসে আছি, সেই সময়টুকুর ফারাক। তবুও আজোও কি ওখানে চকচকে সূর্যটা মানায়?

্# সমগ্র বিশ্বের প্রোপটে সময়টা ছিল শীতল যুদ্ধের কাল। এক দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যদিকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ। যেকোন মুহূর্তে একটা পারমাণবিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা ছিল। সেই সময়টাতে সমগ্র পৃথিবীতে বেকারত্ব বেড়ে গেল, বিভিন্ন স্থানে দুর্ভি ছড়িয়ে পড়েছিল_ এক কথায় গোটা সময়টা ছিল অস্থিতিশীল।

্# তৎকালীন প্রোপটে কবিতাটি লিখা হলেও বর্তমানে এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?

্# সত্যিকার মুক্তি বলতে যা বুঝায় তা তো এখনো আসে নি। একটা পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তনটা কি? তোমার হাতে একটা মোবাইল এসেছে, একটা কম্পিউটার বেড়েছে। অথর্াৎ নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে।

্# আমরা প্রযুক্তির দিক দিয়ে অগ্রসর হয়েছি...

্# না, প্রযুক্তিটা এখানে মিস ইউজ হচ্ছে। আমরা পরিপূর্ণ ভাবে প্রযুক্তিটার ব্যবহার করতে পারছি না। এই প্রযুক্তিটা আমাদের দিকে কে ঠেলে দিল? আমাদের ডেভেলপমেন্ট এর পূর্বেই যে আমাদের হাতে প্রযুক্তি চলে এসেছে এর পেছনে কে? টাকাটা কোথায় যায়? মোবাইলের একটা টাকাও কি বাংলাদেশে থাকে? সমগ্র বাংলাদেশে যে মোবাইল কোম্পানীগুলো আছে, মুখে যে নামেই চলুক না কেন, সবগুলোর মালিক বিদেশীরা। প্রতি মুহুর্তে যে কি পরিমান টাকা চলে যাচ্ছে সেটা অকল্পনীয় ব্যাপার। প্রযুক্তি ব্যবহারে আমার কি লাভবান হচ্ছি? ওরা তো আমার পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে! আমি আবেগের বশবতর্ী হয়ে মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বললাম কিন্তু টাকাটা তো অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে। আর সরকারের ট্যাঙ্রে পরিমাণটা লাভের তুলনায় সামান্যই।


***********************

"সঞ্চয়িতা ফেলে রাখি টেবিলে;/মানসী কিংবা নলিনীর সাথে/মিলাতে পারি না জীবন, আমি/যা দেখি_ সবই অব্সীন!"('জনান্তিক' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# জীবনের এই যে বৈপরিত্যঃ দৃষ্ঠিভঙ্গির ভিন্নতা, পূর্বসূরির সাথে উত্তরসূরির মত পার্থক্য কিংবা দ্বন্দ্ব; সাংস্কৃতিক বিবর্তনে এটা ঘটেই। আপনি ব্যাপারটাকে কোন দৃষ্ঠিভঙ্গিতে দেখেন?

্# দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরিত্য থাকবেই। এটা পজেটিভ বা নেগেটিভ দুটোই হতে পারে। এই ভিন্নতা থাকেই; এটাই নিয়ম।



***********************

এবার অন্য একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইবো, আপনার বসন্তে বৈশাখ কবিতায় আপনি বলেছেন_
"মাটির নরোম বুকে শিকড়ের অনিবিড়/অমতায় যে গাছ মরে যায়/হিসেবী সংসারে কে রাখে তার খবর?"('বসন্তে বৈশাখ'/ বসন্তে বৈশাখ)

্# 'নগর জীবনে মমত্বের বাধন খুবই নাজুক। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, যান্ত্রিকতা কিংবা আধুনিকতা মানুষকে ক্রমশঃ আত্নকেন্দ্রিক করে দিচ্ছে'_ এই অভিযোগ থেকে চলমান প্রজন্মকে আপনি কি করে রেহাই দেবেন?

্# হ্যাঁ, আমাদের যৌথ পরিবারভিত্তিক যে সমাজ; তা ক্রমশ ভেঙ্গে যাছে। আমাদের যৌথ পরিবারে শোষণ, নির্যাতন যা ছিল তাকে আমরা ধামা চাপা দিয়ে রাখতাম। আমরা একজনের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাইতাম। পরিবারে যিনি কর্তা অথর্াৎ যার সবের্াচ্চ মতা ছিল অন্য সদস্যরা তার কথা শুনতে বাধ্য হত। যৌথ পরিবারে মমত্ববোধের একটা ব্যাপার ছিল কিন্তু অন্য দিকে বিচার করলে অনেক যৌথ পরিবারই ব্যক্তিসত্বার বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়টা আমি নিজের জীবনে প্রতি পদে পদে অনুভব করেছি। আমি বার-তের বছর বয়স পর্যন্ত আমার ঘরের বারান্দার বাহিরে যেতে পারিনি। বাইরে যাবার কোন অধিকার আমার ছিল না।

্# এখন যে কথাটা বলা হয়ে থাকে, তা হল_ যান্ত্রিকতার নামে, আধুনিকতার নামে মানুষ অমানবিক হয়ে যাচ্ছে। এখানে মনস্তাত্তি্বক কারণও থাকতে পারে। আমরা জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত পরিবারের উপর নির্ভরশীল থাকি। তারপর যখন অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাই তখন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসি। অধিকাংশ েেত্র বাহ্যিক মমত্ববোধের নামে যা থাকে তা হল নির্ভরশীলতা।

্# এটার কারণ হল সমাজ বিকাশ প্রক্রিয়া যে যে কারণে বাধাগ্রস্থ হয়; সেই কারণে রাষ্ট্রও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে আবার সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। আর সমাজ পিছিয়ে যাওয়া মানে পরিবার পিছিয়ে যাওয়া। এেেত্র দেখা যায় আমাদের পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, ভয়, সম্মানবোধহীনতা এসব কারণই এর জন্য দায়ী। বর্তমানে 'যান্ত্রিকতা' বলতে যা বুঝানো হয় তা আমাদের সুশীল সমাজ কতর্ৃক একটা দাঁড় করানো সংজ্ঞা। তা অস্পষ্ট। যান্ত্রিকতা মানবিকতার পথে কোন বাধা হতে পারে না।


***********************



"হে আমার ঋত্তিক মা করো/আজো যদি জানতে চাও/'বৎস' বড়ো হলে তুমি কি হবে?/সবিনয় বলবোঃ/আপনার যমদূত হবো স্যার।"('ঋত্তিক মা করো' / বসন্তে বৈশাখ)

্# আমরা জানতে চাচ্ছি, পার্থ সারথি চৌধুরী কি তাঁর গুরুর যমদূত হতে পেরেছিল?

্# এটা তো বিদ্রোহী হওয়া। আত্ন সমর্পণ তো সেখায় নত হওয়ার কথা। অনেকেই সততার কথা বলে সততা রাখেন নি। আজকে ইয়াজউদ্দিন সাহেবের কথা চিন্তা কর, নিজের ব্যাপারে যিনি সৎ নন। তবে কবিতার কথা এসেছে অন্য অর্থে।


***********************

"একুশ আজ মোহন মন্দির/একুশ আজ ধ্রুপদী প্রজ্ঞা"('মহাকালের কাব্য' / বসন্তে বৈশাখ)

্# আজ যখন ধ্রুপদী প্রজ্ঞার মন্দিরের বেদীতে অন্যান্যের পাশাপাশি পা পড়ে একাত্তরের ঘাতকদেরও _ তখন কেমন লাগে?

্# একটা জিনিস হল, মানুষের মনের পরিবর্তন হতে পারে। এক সময় আমি ঘোরতর কমিউনিস্ট ছিলাম, আর আজকে আমি কমিউনিজমকে ঘৃণা না করলেও গ্রহণও করতে পারি না। অনেক সময় মানুষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক কিছুর সাথে আপোষ করে। কিন্তু যারা ঘোরতর অপরাধী যেমন; গোলাম আজম, নিজামী। ওরা তো স্বতন্ত্র, ওরা তো ঘাতকদের স্রষ্টা। কিন্তু অনেক সময় আমরা অনেক সাধারণ মানুষকেও দোষারোপ করি। অনেক ডাকাত মুক্তিযোদ্ধ করেছে আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধাও ডাকাতি করেছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি যুদ্ধের পর তারা অনেক বাজে কাজ করেছে। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছিল কিন্তু লোক হিসেবে খারাপ ছিল না। এটা পারস্পরিক অবস্থার প্রেেিত বিবেচ্য।


***********************



"বিবর্ণ প্রহরে ঈশ্বর মরে যায় মুহূর্তে মুহূর্তে।"('ঘণ্ঠা বেজে গেছে' / শিরিষ তলার গাঁথা)

্# আমরা যদি ধরে নিই শুধু বেঁচে তাকে ঈশ্বরের সৃষ্ট স্রষ্টামানবের সৃষ্টি, তবে একজন লেখকের সৃষ্ঠি তাঁকে ভবিষ্যতের নিকট কতটা জীবন্ত করে রাখতে পারে বলে আপনার ধারণা ?

্# একটা জিনিস আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলি, আমি বড় লেখক নই; অত্যন্ত ুদ্র লেখক। তবে আমি যা-ই লিখেছি তাতে মানুষের চিন্তার খোরাক দিতে চেয়েছি। গতানুগতিক ব্যাপারগুলো আমার ভাল লাগে না। একটা লেখাতে যদি মেটারিয়ালস না থাকলো তবে আমি পড়ব কেন?

***********************
অক্ষর-রূপান্তরেঃ
তানসেন আমীন

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, ইসলাম ও প্রজন্মের ব্যবধানে মুখোমুখি পিতাপুত্র

"Our social system, Islam and father/son face to one another because of the Generation Gap"

আমাদের সমাজের মানুষজন কতটা অদ্ভূত তা একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায়। আমাদের কথায় এবং কাজে অমিল আর ভ্রান্ত এবং একঘুয়ে যুক্তি দেখিয়ে যারা জীবন পার করে দিতে চান, আজ সেই সকল পূর্বপুরুষের সাথে সংঘাত দেখা দিচ্ছে উত্তরপুরুষের। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বৈচিত্র নিয়মনীতি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে পিতা-পুত্রকে মুখোমুখি। পুরুষতান্ত্রি সমাজ ব্যবস্থায় কর্তত্ব নির্ধারিত হয় পুরুষকে কেন্দ্র করে। আর তাই বিরোধ বা মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তাদেরকেই। কেউ যদি প্রথা ভেঙে বেরুতে চায়, তাহলে তার ক্ষেত্রেই এই সমস্যাটি দেখা দেয়। যার প্রধান কেন্দ্রে রয়েছে ধর্ম। ধর্মকে কেন্দ্র করে বাস্তবতার নিরিখে চলুন দেখি একটি সংলাপঃ

যখন ধর্ম এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসী কোনও মানুষ, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে অন্য কাউকে প্রশ্ন করেন, এবং উত্তরে যদি শুনতে পান যে উত্তরদাতা নাস্তিক, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নকর্তার ঠোঁটে একধরণের তাচ্ছিল্যের হাসি খেলা করে। এই হাসি দেয়ার পর অনেকেই যে মন্তব্যটি করেন তা হচ্ছেঃ

“হেহ ! নাস্তিক্য ! এটা তো আজকাল একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।”

এমন নাস্তিক সম্ভবত একজনও পাওয়া যাবে না, যিনি এই কথাটি জীবনে একবারও শোনেননি। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ তার “আমার অবিশ্বাস” বইয়ের “বিশ্বাসের জগৎ” প্রবন্ধে লিখেছেনঃ

“একটা কিছু বিশ্বাস করতে হবে মানুষকে, বিশ্বাস না করা আপত্তিকর। আপনার পাশের লোকটি স্বস্তি বোধ করবে যদি জানতে পারে আপনি বিশ্বাস করেন, তার বিশ্বাসের সাথে আপনার বিশ্বাস মিলে গেলে তো চমৎকার; আর খুবই অস্বস্তি বোধ করবে, কোনো কোনো সমাজ আপনাকে মারাত্মক বিপদে ফেলবে, যদি জানতে পারে আপনি বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস কয়েক হাজার বছর ধ’রে দেখা দিয়েছে মহামারী রূপে; পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী মহামারীর নাম বিশ্বাস।”

বলাই বাহুল্য, এই বিশ্বাসটি হচ্ছে ধর্ম এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস, এবং মহামারীটি হচ্ছে ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসের রোগ। ভাবটা এমন যে, সবাইকে এই রোগে আক্রান্ত হতেই হবে, সবাইকে একই গোয়ালের গরু হতেই হবে। কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত না হয়, তাহলেই তার আরোগ্য, অর্থাৎ নাস্তিক্য, হয়ে যায় বাকী সবার চোখে ফ্যাশন, বা শো-অফ করার উপায়।

পুত্রঃ
আপনি ধর্মের নামে গাছ-পালা, মূর্তি-পাথর বা গরু-ছাগল কিংবা কালো-সাদা ঘরবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শারীরিক কসরৎ করলে সেগুলো অস্বাভাবিক হয়না, আর কেউ যদি সেগুলো না করে, তবেই সে অস্বাভাবিক হয়ে যায়? কী কারণে নাস্তিক্যকে শো-অফ বলা হচ্ছে ?
পিতাঃ
“এটা সবার চেয়ে আলাদা হতে চাওয়ার একটা প্রবণতা। ধর্ম নিয়ে উলটাপালটা কিছু বললেই বিখ্যাত হওয়া যায়, বিতর্কিত হওয়া যায়। আর বিখ্যাত হওয়ার এই সহজ পথ কে ছাড়বে? নাস্তিক্য তো একটা ফ্যাশন!

পুত্রঃ
মানুষের বিশ্বাস যদি হয় ফ্যাশন বিচারের মাপকাঠি, তাহলে ইসলাম একটা ফ্যাশন, হিন্দুধর্ম একটা ফ্যাশন এবং পৃথিবীর যাবতীয় বিশ্বাস হচ্ছে ফ্যাশন। সেই অনুযায়ী, আপনি যদি ধর্ম পালন করে ফ্যাশন দেখাতে পারেন, তাহলে আমি ধর্ম পালন না করে ফ্যাশন দেখাতে পারবো না কেন ?

পিতাঃ
না মানে, বলতে চাইছি এটা বাকী সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার একটা চেষ্টা, তাই না ?

পুত্রঃ
নির্দিষ্ট ধর্ম পালনই হচ্ছে আসলে মানুষের চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা। আপনি একটি ধর্ম গ্রহণের সাথে সাথে ওই ধর্মটি বাদে পৃথিবীর বাকী ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে গেলেন, তাই নয় কি ? শুধু তাই নয়, এটা আপনাকে একেবারেই আলাদা করে দেবে। এক ধর্মের বিশ্বাসের সাথে আরেক ধর্মের বিশ্বাসে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক ধর্ম অন্য ধর্মকে বাতিল করে দেয় এবং অন্য ধর্মাবলম্বীকে ভালো চোখে দেখে না। তাই আপনাকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে শত হাত দূরে থাকতে হবে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে ? ধর্ম পালন হচ্ছে বাকী সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা।

পিতাঃ
এটা আসলে হুমায়ুন আজাদ বা তসলিমার মত বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা !

পুত্রঃ
তাহলে ইসলাম পালন হচ্ছে জাকির নায়েকের মত বা হিন্দু ধর্ম পালন করা হচ্ছে সাঁই বাবার মত বিখ্যাত হওয়ার প্রচেষ্টা। একজন হুমায়ুন আজাদ বা তসলিমা বাংলাদেশে বিখ্যাত হয়েছেন বটে, কিন্তু ধার্মিক হয়ে তো আরও ব্যাপক লাভ। বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ববিখ্যাত ধার্মিক জাকির নায়েকের মত কোনও বিশ্ববিখ্যাত নাস্তিকের নাম বলুন তো, যাকে সাধারণ মানুষ এক নামে চিনবে ! পারবেন কি ? তো নাস্তিক্যের হাত ধরে যদি জনপ্রিয়তা না-ই আসে, তাহলে নাস্তিক্য আর জনপ্রিয় হওয়ার হাতিয়ার থাকলো কীভাবে ? আমি তো বরং বলতে পারি, জনপ্রিয় হওয়ার নয়, বরং নাস্তিক্য হচ্ছে ধর্ম-সংবেদনশীল দেশে বেঘোরে নিজের প্রাণটা হারানোর হাতিয়ার। জনপ্রিয় হুমায়ুন আজাদ বা জনপ্রিয় তসলিমার পরিণতি আপনাদের মত ধার্মিকেরাই কী করেছে, তা কি আমরা দেখিনি ? C.T.V.N. চ্যানেলের অনুষ্ঠানে ভারতীয় যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেরা ধনী জ্যোতিষী “আচার্য্য সত্যানন্দ”। কে চায় অযথা জনপ্রিয় হতে গিয়ে নিজের গলা “বিসমিল্লাহ” বা “ওঁ” লেখা ছুরির নিচে পেতে দিতে?

পিতাঃ
না ঠিক আছে, নাস্তিক তুমি, ভালো কথা। কিন্তু আজকাল তো অনেকে না জেনেই নাস্তিক হয়। কিছুই জানে না, অথচ বলছে আমি নাস্তিক। ফেসবুকে রিলিজিয়াস ভিউ দিয়েছে এথিস্ট। এগুলো আসলে ভাঁওতাবাজী এবং লোক-দেখানো কাজ।

পুত্রঃ
নাস্তিক হওয়ার জন্য যে অনেক কিছু জানতেই হবে, এটা কে বলেছে ? আপনি যখন নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দেন, তখন কি কেউ জানতে চায়, যে আপনি আপনার ধর্মের যাবতীয় বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানেন কিনা ? ফেসবুকে যখন আপনি রিলিজিয়াস ভিউ থিস্ট লেখেন, তখন কি কেউ ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি কেন থিস্ট ? যে কোনও বিষয় সম্পর্কেই জানা ভালো, কিন্তু জানা বিষয়টাকে আপনি শর্ত হিসাবে দিতে পারেন না। আপনি যেমন সবকিছু জেনে ধার্মিক হতে বাধ্য নন, আমিও সবকিছু জেনে নাস্তিক হতে বাধ্য নই।


পিতাঃ
যদি গুটিকয়েক বালক-বালিকা নিজেদের পরিচয় দেয় নাস্তিক হিসেবে “জাস্ট ফ্যাশন” বলে, তাতেও তো ক্ষতিকর কিছু নেই। ফ্যাশন মানেই খারাপ, তা তো নয়! বরং ধার্মিক হবার ফ্যাশন, এটাই সত্যিকারের ফ্যাশন। কারণ, অধিকাংশ পাবলিক কিছু না জেনে ধর্মবিশ্বাস নামের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়।

পুত্রঃ
যারা পারিবারিক সূত্রে কোনও একটা ধর্ম পেয়েছে এবং লালন করে চলেছে, তারা কিন্তু না জেনেই ধার্মিক। বেশির ভাগ ধার্মিকই না জেনে ধার্মিক। একটা শিশুর জন্মের সাথে সাথেই সে পরিবারের ধর্মটা পেয়ে যায়। তখন কিন্তু কেউ প্রশ্ন করে না যে, এই শিশু জেনে ধার্মিক, নাকি না জেনে ধার্মিক।
তাই, না জেনে ধার্মিক, আর না জেনে নাস্তিক সমান কথা। এটা একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপরে নির্ভর করে যে সে কী মানবে বা মানবে না। সে যদি না জেনেই কিছু মানে, তাহলে যদি ভ্রু কোঁচকানোর কিছু না থাকে, তাহলে যদি কেউ না জেনেই কিছু না মানে, তাহলেও ভ্রু কোঁচকানো যাবে না।

পিতাঃ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভ্রু কোঁচকানোর কারণটা কী?

পুত্রঃ
মানুষ সব সময়ই চায় দলে ভারী হতে। যেমনঃ আপনার পাশের লোকটি আপনার কোনও কথার সাথে একমত হলে আপনি তাকে স্বাভাবিকভাবেই নিজের মত একজন লোক বলে মনে করেন, এবং নিজের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পান, একটা সমর্থন বা সাপোর্ট পান। মানুষের সাইকোলজিকাল ক্যারেক্টারই এরকম। যে কেউ নিজের মতের পক্ষে সমর্থন পেলে সুখী বোধ করে।

তা ধার্মিকেরা সুখী বোধ করুন, সমস্যা নেই। তাদের মতের সমর্থন দেয়ার জন্য পৃথিবীতে মানুষের অভাব পড়ে যায়নি। তবে নাস্তিকদের সেই সমর্থনটা দরকার হয় না। কেউ সমর্থন করবে না জেনেই নাস্তিকেরা নাস্তিক হয়। পরিবারের সমর্থন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না, থাকে না বন্ধু-বান্ধবদের সমর্থন। শুধু নাস্তিক্যের কারণেই যে পরিমাণ বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়, তাতে নাস্তিকদের কেমন লাগে ? ভালো নিশ্চয়ই লাগে না ! অ্যাকটিভ নাস্তিকদের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে ধার্মিক প্রিয় মানুষগুলোর সাথে। কিন্তু এটা কি হওয়া উচিত ? নাস্তিক্যকে ফ্যাশন বা একধরনের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ধার্মিকেরা যে ক্রমাগত নাস্তিকানুভুতিতে আঘাত দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা কি মেনে নেয়া যায় ?

অথচ, এই নাস্তিকেরাই যখন ধর্মের সমালোচনা করেন, তখন ধার্মিকেরা চিৎকার করতে থাকেন, “অন্য মতের ওপর শ্রদ্ধা থাকা উচিত।” এই শ্রদ্ধাটা ধার্মিকরা নাস্তিকদের মতের ওপর দেখাচ্ছেন না কেন ?

বিচার কি সবার জন্য একই মাপকাঠিতে হওয়া উচিত নয় ?

পর্দাপ্রথা ও ইসলাম; নারীর অগ্রগতি দমনের সূক্ষ্ণ কৌশল।

ধর্ম যখন মানুষের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন কল্যানের চেয়ে অকল্যানই বেশী ঘটে একটি জাতির জীবনে। তাই হয়ে এসেছে চীরকাল, ইতিহাস তাই বলে। অথচ কে না জানে, মানুষের জন্য ধর্ম এসেছিল, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। আজ যেনো মানুষ হয়ে গেছে গৌণ আর ধর্ম হয়ে উঠেছে মূখ্য এক শ্রেণীর মোল্লা-পুরোহিতদের কাছে। আর এই ধর্মের নামে তথাকথিত শরিয়ত এর খাতিরে নারী সমাজকে বলি হতে হচ্ছে মোল্লাতন্ত্র আর পুরোহিতের যাঁতাকলে।
ইসলাম ধর্মে নারীকে যতটা না অবরোদ্ধ রাখার প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে, আর সকল ধর্ম মিলেও তার সমান হবে না।
ইসলামী দেশ এবং এর রীতিনীতির মধ্যে যা আসে তার মধ্যে পর্দাপ্রথা বা হিজাব অন্যতম।
আমাদের দেশ সাংবিধানিক ভাবে ধর্মীয় হলেও গণতান্ত্রিক শাষণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও কোরান ও সুন্নাহর শাসন ব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই নাগরিকরা কিছুটা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন এবং বিধর্মীরা একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন। কিন্তু কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক শাষণ ব্যবস্থা চালুর জন্য মরিয়া কিছু উগ্র ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং এর অংগ সংগঠনগুলো ইসলামী বিভিন্ন কট্টরপন্থি নিয়মনীতি চালু করে দিয়েছে। তার মধ্যে হিজাব উল্লেখ্যযোগ্য। কারণ তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নারী। কেনোনা তারা জানে একটি নারীকে বন্দী করতে পারলে পরিবারকে বন্দি করা সম্ভব। তাছাড়া, নারী জাতি সহনশীল এবং তুলনামুলকভাবে কম প্রতিবাদী হওয়ায় তাদেরকেই লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছে উগ্র ইসলামী গুষ্ঠিগুলো। আর এর প্রভাব পড়েছি বাংলাদেশের সর্বত্র। কিন্তু একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এই আরোপিত হিজাব কে সমর্থ করতে পারি না।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জনের মত মুসলিম। স্বাভাবিক ভাবে জন্মগতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হচ্ছে ইসলাম। নারী পুরুষের সংমিশ্রণে এই দেশ। আর নারী ও ইসলাম নিয়ে কথা উঠলেই কথা আসে পর্দাপ্রথার অর্থাৎ হিজাবের। ইসলামে নারী ও পুরুষ সবাইকে পোষাকের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া আছে। কিন্তু কাজ ভেদে, খেলাধূলার ধরন ভেদে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে, ভৌগলিক অবস্থান ও অঞ্চল ভেদে, কখনো বা সময়ের প্রভাবে পোষাক যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাল্টায়। যাতে ঐ বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ তার ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু ইসলামে নারীর পোষাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ পোষাকের এই যৌক্তিক কার্যকারণগুলোকে মানে না। তাই এত বিতর্ক।
অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মুসলিম নারীসমাজ এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ করতে পারেননি। মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে এই পর্দাপ্রথা হয়ে উঠেছে প্রধান অন্তরায়। দাসত্বের এই প্রতীকের জন্য তারা ক্ষমাগত নিম্নমুখি হচ্ছে। পুরুষ আধিপত্যের শেকল ছিঁড়ে নিজ গৃহের বন্দিত্ব থেকেই মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে নারীরা এর বিরোধীতা করে নি তা নয়। মুসলিম রমণীরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এসব প্রথার বিরুদ্ধে। ১৯২৩ সালে মিশরে প্রথম একটি প্রতিবাদ হয়, মিশরের ফেমিনিস্ট ইউনিয়নের প্রধান মিজ হুদার নেতৃত্বে। তিনি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে তাদের পর্দা ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। তুরস্কে হিজাবের বিরুদ্ধে সরকার থেকে লড়াই শুরু হয় ১৯২৭ সালে। তখন কম্যুনিস্ট সরকার ছিল ক্ষমতায়। সেই সময় ৭,০০০ মহিলা প্রকাশ্যে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের সাথে শত্রুতা করার জন্য তাদের ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজকের যে কট্টর আফগানিস্তান সেখানেও বাদশা শাহ এর সময় স্বাধীনতা উৎসবে, ১৯২৮ সালে পর্দাপ্রথার শেকল থেকে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে জনসম্মুখে পর্দা ছাড়া উপস্থিত হতে বলেছিলেন। পরে মুসলিম মৌলবাদীর ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে নারী মুক্তির সব ধরনের প্রকল্প তাকে বাদ দিতে হয়েছিল। ক্ষমতাও ছাড়তে হয় তাকে। ইরানের রেজা শাহ ১৯৩৬ সালে একটি বিশেষ আইন করে 'চাদর' পরা বন্ধের আদেশ দেন। কিন্তু সংস্কৃতির বিপক্ষে তার এই আদেশ জনপ্রিয়তা পায়নি এবং জনপ্রতিবাদের মুখে ১৯৪৬ সালে তিনি আবার তা পুনর্বহাল করেন।

পর্দা নারীর মুক্ত বিচরণকে রুদ্ধ করে দেয় এটি বলার অবকাশ রাখে না। যদিও মুসলিম রমণীদের অনেকে তাদের প্রয়োজনমত এসব নিয়মকানুনকে একটু মোচড়ে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব একটা সরব প্রতিবাদে তারা সহজে জড়াতে চান না সাধারণত পরিবার সমাজ ধর্ম এবং রাষ্ঠ্র আরোপিত শাস্তির ভয়ে। কিন্তু ‘হিজাবের’ অর্থ কেবল পোষাকের মাঝে জড়িত মনে করলে ভুল করা হবে। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরো অনেক নিয়ম-নীতি। যদি প্রশ্ন উঠে যে মুসলিম নারীর কি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে? এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে তার নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাও হিজাবের বা পর্দা প্রথার অংশ।
এ বিষয়ে কোরানের সংশিস্নষ্ট আয়াত হচ্ছে ৩৩.৩৩: “And stay quietly in your houses, and make not a dazzling display, like that of the former Times of Ignorance; and establish regular Prayer, and give regular Charity; and obey Allah and His Messenger. And Allah only wishes to remove all abomination from you, ye members of the Family, and to make you pure and spotless.”
এই যে ঘরের মধ্যে নীরবে থাকার নির্দেশ; তা কোরানের। যারা ইসলামের সংশোধনে বিশ্বাসী এবং নিজেকে বিতর্কের বাহিরে রাখতে চান তারা এর সাথে আগের আয়াত যুক্ত করে একে চিহ্নিত করেন শুধুমাত্র নবীর স্ত্রীদের জন্য আদেশ বলে। যদিও নবীর কাজ এবং সম্মতি হাদিসের আওতায় পড়ে। যারা গোঁড়া/উগ্র মৌলবাদী কিংবা ইসলামী শাসন কায়েমে বিশ্বাসী তাদের মতে এই আদেশ সকল মুসলিম রমণীদের জন্য।
আজকের আধুনিক সমাজে যখন দেখি কোনো সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধ্যান-ধারণা এবং চেতনা দিয়ে নারীকে পর্দা বা হিজাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখার দলগত এবং ব্যক্তিগত চেষ্ঠায় লিপ্ত তখন অবাক এবং প্রতিবাদ না করে পারি না। এই একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের বাংলাদেশে চলছে নারীকে হিজাবের আবরণে আবদ্ধ করার প্রচেষ্ঠা। পর্দাপ্রথা ও ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীকে অবরোদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সময় এসেছে পর্দা ছুড়ে ফেলে, নিজের সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস এর মোহ থেকে মুক্ত করে যুক্তি এবং বাস্তবতার আলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার। নারী দিবসে এই কামনা ব্যক্ত করছি।